
গাজায় রক্তপাত যেন থামছেই না। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত শুক্রবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক। গাজার গণমাধ্যম দপ্তর জানিয়েছে, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ইসরাইল ৮০ বার যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
যুদ্ধবিরতির পরেও অব্যাহত বোমা হামলা
শুক্রবার সন্ধ্যায় গাজা সিটির জেইতুন এলাকায় একটি পরিবারের উপর ট্যাঙ্ক শেল নিক্ষেপ করে ইসরাইলি সেনারা। এতে একই পরিবারের ১১ জন সদস্য নিহত হন, যাদের মধ্যে সাতজন শিশু ও তিনজন নারী।
গাজা বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, পরিবারটি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। ঘটনাস্থলেই সবাই নিহত হন।
এছাড়া রাফাহ, খান ইউনুস, দেইর আল-বালাহসহ দক্ষিণ গাজার বিভিন্ন এলাকায়ও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় আরও ২৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানায় স্থানীয় সূত্র।
ইসরাইলের দাবি ও হামাসের অস্বীকার
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র দাবি করেছেন, হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্ত এলাকায় রকেট নিক্ষেপ করেছে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে।
তবে হামাস এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য, যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা অবস্থায় কোনো সামরিক অভিযান তারা চালায়নি। বরং ইসরাইলই ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করছে এবং সাধারণ নাগরিকদের টার্গেট করছে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল গাজায় অব্যাহত হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, যুদ্ধবিরতির পরও এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “যুদ্ধবিরতি যদি শুধু কাগজে থাকে, আর মাটিতে রক্ত ঝরে, তাহলে সেটি শান্তি নয়, কেবল প্রতারণা।”
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “আমাদের অবস্থান স্পষ্ট — আমরা চাই গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।” তিনি আরও জানান, ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে। তবে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক মানবাধিকার সংগঠন।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং এক লাখ সত্তর হাজারেরও বেশি আহত।
এদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। অনেক এলাকায় এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে শতাধিক মরদেহ, যেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতির কারণে।
মানবিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় এখন খাদ্য, পানি ও ওষুধের ভয়াবহ সংকট চলছে। প্রায় ৯০ শতাংশ হাসপাতাল আংশিক বা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, গাজার দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, অনেক মা তাদের সন্তানকে বাঁচাতে বুকের দুধের বদলে দূষিত পানি খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
শিশু ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
গাজার শিশু হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “প্রতিদিনই আমরা নতুন নতুন শিশুদের মৃতদেহ পাচ্ছি। তাদের অনেকেই খেলতে খেলতে মারা গেছে, কেউবা মায়ের কোলে।”
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, গাজায় প্রতি ঘন্টায় গড়ে একজন শিশু নিহত হচ্ছে। এ পরিসংখ্যান বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি কি কেবল কাগজে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি এখন কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক হাসান আল-কাসিম বলেন, “ইসরাইলের হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি বাস্তব অর্থে কার্যকর হতে পারে না। এটি কেবল সময়ক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেওয়ার কৌশল।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরাইল সব সময় মানবিক করিডোর বন্ধ রাখে, ফলে গাজাবাসীরা পালানোর সুযোগও পায় না। এটি এক ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ, যা ধীরে ধীরে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করছে।”
ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা অব্যাহত
গাজার উত্তরাঞ্চল, যেখানে একসময় হাজারো পরিবার বাস করত, এখন প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
বেশিরভাগ মানুষ এখন আশ্রয় নিয়েছে স্কুল বা জাতিসংঘ পরিচালিত শিবিরে। কিন্তু সেখানে জায়গা সংকটের কারণে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রামি আবু সালেহ বলেন, “প্রতিদিন আমরা দেখি নতুন মৃত্যু, নতুন কষ্ট। আমাদের শিশুরা এখন ভয়েই বড় হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি বলে কিছু নেই, আছে কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম।”
আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে ইসরাইলের উপর
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত দাবি করেছে।
রয়টার্স জানায়, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়াম গাজার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। তারা বলছে, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
এদিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, “ইসরাইল নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় যেকোনো পদক্ষেপ নেবে।”
তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই যুক্তি এখন অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে, কারণ হামলার শিকার হচ্ছেন নিরীহ সাধারণ মানুষ, যাদের সঙ্গে কোনো সামরিক সম্পর্ক নেই।
মানবিক করিডোর খোলার দাবি
মিশর ও কাতার গাজার জন্য মানবিক করিডোর খোলার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, আহতদের সরিয়ে নেওয়া ও ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য অন্তত ৭২ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা জরুরি।
তবে ইসরাইল এখনো সেই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি। এর ফলে মানবিক সহায়তা আটকে আছে রাফাহ সীমান্তে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কত দূর
বিশ্বজুড়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ এখন একটাই প্রশ্ন করছে — “এই যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই যুদ্ধের অবসান ঘটাবে?”
বিশ্লেষকদের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইল দখলনীতি বন্ধ না করে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দেয়, ততক্ষণ কোনো যুদ্ধবিরতি টেকসই হবে না।
গাজার শিক্ষক ইউনুস দারবিশ বলেন, “আমাদের সন্তানরা এখন বর্ণমালা শেখার বদলে বোমার শব্দ চিনে। এটা কি কোনো জাতির ভবিষ্যৎ হতে পারে?”
গাজা এখন মৃত্যু ও ধ্বংসের আরেক নাম। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কেবল সংবাদে, বাস্তবে প্রতিদিনই নতুন করে রক্ত ঝরছে।
বিশ্বের বিবেক এখন একটাই প্রশ্ন করছে — কবে থামবে এই যুদ্ধ, কবে বাঁচবে গাজার শিশুরা?
MAH – 13397 I Signalbd.com