
টোকিও থেকে প্রতিবেদন
জাপানের রাজনীতিতে নতুন এক যুগের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয় বিভাজন ও নেতৃত্ব সংকটের পর দেশটি এখন জোট সরকারের পথে হাঁটছে। এই জোট সরকারের নেতৃত্বে উঠে আসছেন সানায়ে তাকাইচি — যিনি হতে যাচ্ছেন জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
এই খবরটি এখন শুধু জাপান নয়, গোটা এশিয়া এবং বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জাপান কখনো নারী প্রধানমন্ত্রী দেখেনি। তাই সানায়ে তাকাইচির নেতৃত্বে নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে দেশটিতে।
রাজনৈতিক পটভূমি: কেন জোটের প্রয়োজন হলো
জাপানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে গত কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছিল। শিনজো আবে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই দেশটির রক্ষণশীল দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে পড়ে। একের পর এক কেলেঙ্কারি, দুর্বল অর্থনীতি ও নেতৃত্বের প্রশ্নে দলের ভাবমূর্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।
২০২৫ সালের অক্টোবরের শুরুতে অনুষ্ঠিত এলডিপির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে সানায়ে তাকাইচি দলটির নতুন নেতা নির্বাচিত হন। তবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি।
এরপর থেকেই এলডিপি নতুন জোট গঠনের জন্য নানা দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। অবশেষে ডানপন্থি ছোট দল জাপান ইনোভেশন পার্টি (জেআইপি)-র সঙ্গে ঐক্যমতের ভিত্তিতে জোট গঠনের পথে হাঁটে এলডিপি।
রবিবার ওসাকায় জেআইপি নির্বাহী বোর্ডের বৈঠকে এই জোট গঠনের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়। আজ সোমবার উভয় দলের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সানায়ে তাকাইচি: জাপানের নতুন মুখ, নতুন ইতিহাস
সানায়ে তাকাইচি জাপানের রাজনীতিতে বহুদিন ধরেই পরিচিত মুখ। রক্ষণশীল মতাদর্শের অনুসারী এই নারী রাজনীতিবিদ ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ হিসেবে পরিচিত।
তাকাইচি বহু বছর ধরে নারী নেতৃত্বের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, আধুনিক জাপানকে এগিয়ে নিতে হলে নারীদের আরও বেশি করে রাজনীতির মূলধারায় আনতে হবে।
একাধিকবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা তাঁকে নেতৃত্বের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তাকাইচি দেশের রক্ষণশীল ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হলেও, নারী হওয়ায় তিনি প্রগতিশীল ও তরুণ প্রজন্মের কাছেও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
জোট চুক্তির মূল বিষয়গুলো
জোট সরকারের চুক্তিতে অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা খাতে একাধিক সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে।
দুদলই একমত যে, জাপানের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও শ্রমবাজারের সংকট মোকাবিলায় নতুন পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।
চুক্তির মূল দিকগুলো হলো:
- অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর রেয়াত ও প্রযুক্তি সহায়তা বাড়ানো হবে।
- প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি: আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
- জলবায়ু ও জ্বালানি নীতি: নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে ফসিল জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে।
- নারী নেতৃত্বের প্রসার: সরকারি ও বেসরকারি খাতে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধির জন্য আলাদা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হবে।
এই চুক্তি চূড়ান্ত হলে মঙ্গলবারই তাকাইচি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার চ্যালেঞ্জ
তবে সব কিছু এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। জোট গঠন করলেও এলডিপি ও জেআইপি একত্রে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারছে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দুদলকে আরও দুইটি আসনের সমর্থন প্রয়োজন।
তবে জাপানের সংবিধান অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফা ভোটে যদি কোনো প্রার্থী সর্বাধিক সমর্থন পান, তাহলে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
সেই প্রেক্ষাপটে তাকাইচির জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এলডিপির পুরনো মিত্রের প্রস্থান
গত মাসে এলডিপির দীর্ঘদিনের সহযোগী দল কোমেইতো সরকার ত্যাগ করে।
২৬ বছর পর এই বিচ্ছেদ জাপানের রাজনীতিতে বড় ধাক্কা হয়ে আসে।
কোমেইতো মূলত মধ্যপন্থী ও ধর্মভিত্তিক দল, যাদের সমর্থন দীর্ঘদিন ধরে এলডিপির সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিল।
তাদের প্রস্থানেই রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং নতুন করে জোটের প্রয়োজন দেখা দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে তাকাইচি নেতৃত্বে নতুন জোট সরকার গঠন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাপানের জনগণের প্রত্যাশা
জনগণের মধ্যে তাকাইচির জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে। অনেক তরুণ ভোটার তাঁকে পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে দেখছেন।
বিশেষ করে নারী সমাজের মধ্যে তার উত্থানকে একটি ‘ইতিহাস গড়া মুহূর্ত’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশ্লেষক হিদেও ওকামোতো বলেন,
“তাকাইচি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি এমন এক নারীর প্রতীক যিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমা ভেঙে সামনে এসেছেন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া জাপানের জন্য এক বড় বার্তা।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন কূটনৈতিক কৌশল নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যে তাকাইচির নেতৃত্বকে স্বাগত জানিয়েছে।
অন্যদিকে চীন কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, কারণ তাকাইচি পূর্ব চীন সাগরে জাপানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় অবস্থানের জন্য পরিচিত।
তুরস্ক, কাতার ও মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
বিশেষ করে গাজা পুনর্গঠনে সহযোগিতার উদ্যোগে জাপানের নতুন ভূমিকা রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন তাকাইচি।
নারী নেতৃত্বে জাপানের নতুন অধ্যায়
জাপান ঐতিহাসিকভাবে পুরুষ নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র।
কিন্তু সময় বদলাচ্ছে — কর্মক্ষেত্রে, প্রযুক্তিতে ও সমাজে নারীদের অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে একজন নারী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তাকাইচি বলেছেন,
“আমি চাই জাপানের প্রতিটি নারী যেন নিজেকে নেতা হিসেবে কল্পনা করতে পারে। আমাদের সমাজে সুযোগ ও সমান অধিকারই হবে উন্নয়নের মূল ভিত্তি।”
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকাইচির সামনে থাকবে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ:
- অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠা
- জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যা মোকাবিলা
- প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় জাপানের অবস্থান মজবুত করা
- আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা জোরদার করা
এছাড়া, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করাও হবে তার অন্যতম বড় দায়িত্ব।
জাপান এখন এক নতুন সূচনার দ্বারপ্রান্তে।
যদি আজ চূড়ান্তভাবে জোট চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং তাকাইচি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন, তবে এটি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয় — এটি হবে সামাজিক রূপান্তরের এক অনন্য উদাহরণ।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান নতুন নেতৃত্বে কোন পথে হাঁটে, সেটিই এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
MAH – 13396 I Signalbd.com