
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, যদি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি না মানে, তবে তিনি ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজায় আবার অভিযান শুরু করার অনুমতি দেবেন। সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি বললেই লড়াই আবার শুরু হবে।” এই মন্তব্যের পর মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন হুঁশিয়ারি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। বুধবার (১৫ অক্টোবর) সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যদি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে আমি ইসরায়েলকে বললেই তারা আবার যুদ্ধে নামবে।”
তিনি আরও বলেন, “হামাসের সঙ্গে যা ঘটছে, তা খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যদি তারা চুক্তি না মানে, তাহলে আমাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না।”
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরেই ইসরায়েলি রাজনীতিক ও সামরিক মহলে আলোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি কেবল সতর্কবার্তা নয়, বরং গাজার পরিস্থিতি অচিরেই আবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে।
ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি
ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ২০ দফা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, হামাসকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জীবিত ও মৃত বন্দিকে ইসরায়েলের হাতে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছিল।
তবে ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস এখনো পুরোপুরি চুক্তি মানছে না। তারা জানায়, এখন পর্যন্ত ২০ জন জীবিত বন্দি ফিরিয়ে দেওয়া হলেও কেবল আটটি মৃতদেহ হস্তান্তর করেছে হামাস। এর মধ্যে চারটি দেহ মঙ্গলবার রাতে ফেরত দেওয়া হয়, যার একটি ইসরায়েলি নাগরিক নয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
এ ঘটনায় ইসরায়েলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামাসের অঙ্গীকার পূর্ণ না হওয়ায় গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ সাময়িকভাবে সীমিত করা হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও মধ্যস্থতা
এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না যে হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করছে। বরং মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে হামাস জানিয়েছে, এখনো অনেক বন্দির মৃতদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকতে পারে, তাই উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সময় লাগবে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বলেন, “আমরা এখনো যুদ্ধবিরতিকে কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করছি। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, হামাস যদি নিরস্ত্র না হয় এবং তাদের চুক্তির দায়িত্ব পালন না করে, তবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
গাজার অভ্যন্তরে অস্থিরতা বাড়ছে
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়। হামাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।
ট্রাম্প সাক্ষাৎকারে বলেন, “এখন হামাস নিজেই গাজায় সহিংস অন্য গোষ্ঠীগুলোকে উৎখাত করছে। আমরা খতিয়ে দেখছি তারা নিরপরাধদের ক্ষতি করছে কি না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই গাজা একটি নিরস্ত্রীকৃত ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে পরিচালিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংসতা আর না ঘটে।”
গাজা সংকটের দীর্ঘ ইতিহাস
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘাত নতুন কিছু নয়। ২০০৭ সালে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে হামাস ও ইসরায়েল বহুবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে। প্রতিবারই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলেও তা টেকেনি।
ট্রাম্প প্রশাসন এবার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী সমাধান আনার চেষ্টা করছে। এতে গাজাকে নিরস্ত্রীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রশাসন পরিচালনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গাজার বর্তমান বাস্তবতায় এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। হামাস এখনো রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্ত অবস্থানে আছে, যা ইসরায়েল বা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি প্রকাশের পর জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লীগ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফেন ডুজারিক বলেন, “যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি। যে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গাজার মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলবে।”
অন্যদিকে তুরস্ক ও কাতার, যারা হামাসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছে যেন কূটনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “লড়াই আবার শুরু হলে শুধু গাজা নয়, পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে।”
ট্রাম্পের বার্তা রাজনৈতিক না সামরিক?
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আগামী বছরের মার্কিন নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর ইসরায়েলপন্থী ভোটারদের সমর্থন পেতে এমন বক্তব্য দিতে পারেন।
তবে বিশ্লেষক ড. সামির নাসির বলেন, “ট্রাম্পের প্রতিটি বক্তব্যের প্রভাব বিশ্বরাজনীতিতে পড়ে। তিনি যেভাবে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপের কথা বলেন, তা হামাসসহ অন্যান্য পক্ষকে আরও উস্কে দিতে পারে।”
অন্যদিকে মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক জেসন ফিলিপস বলেন, “ট্রাম্প মূলত চাপ প্রয়োগের কৌশল ব্যবহার করছেন। হামাস যদি দ্রুত বন্দিদের ফেরত দেয়, তবে হয়তো যুদ্ধবিরতি টিকবে। তবে তিনি ইসরায়েলকে আবার মাঠে নামার অনুমতিও দিতে পারেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়।”
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্য আবারও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। হামাস যুদ্ধবিরতির শর্ত কতটা মানে, সেটিই এখন নির্ধারণ করবে গাজার ভবিষ্যৎ।
বিশ্লেষকদের মতে, সাময়িক যুদ্ধবিরতির এই সময়টিই হতে পারে স্থায়ী শান্তির পথে শেষ সুযোগ। কিন্তু ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি বাস্তবায়িত হলে, গাজার ভূমি হয়তো আবারও রক্তে রঞ্জিত হতে পারে।
এম আর এম – ১৮০৫,Signalbd.com