
মিশর সীমান্তবর্তী গাজার রাফাহ ক্রসিং দীর্ঘদিন ধরে মানবিক ত্রাণ পৌঁছানোর প্রধান পথ হিসেবে বিবেচিত হলেও, ইসরায়েলের নতুন বিধিনিষেধের কারণে এটি এখনও খোলা হচ্ছে না। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি বারবার ত্রাণ প্রবেশের গুরুত্ব তুলে ধরলেও তেলআবিবের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) জাতিসংঘকে জানানো হয়, আপাতত গাজার উপত্যকায় মাত্র ৩০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। এর আগে ইসরায়েল অন্তত ৬০০টি ট্রাক ঢোকার অনুমতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জাতিসংঘও সমপরিমাণ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে গাজার বিভিন্ন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন ত্রাণ আটকে আছে, যা অবিলম্বে জনসাধারণের মধ্যে মানবিক সংকট সৃষ্টি করছে।
ত্রাণ সরবরাহে জটিলতার কারণ
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী রাফাহ ক্রসিং বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে কারণ হামাস এখনও বেশ কয়েকজন জিম্মির মরদেহ ফেরত দেয়নি। সূত্রের দাবি, মরদেহ ফেরত না দিলে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবেশ করানোও কঠিন হবে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, মানবিক ত্রাণকে রাজনৈতিক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা মানুষিক অধিকার লঙ্ঘন। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের জন্য ত্রাণ অত্যন্ত জরুরি।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি
গাজা উপত্যকায় বিদ্যমান সংকট মানবিক ও সামাজিক দুই দিকেই মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিদিনই হুমকির মুখে। ত্রাণে বাধা সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষ খাদ্য সংকট, পানি সমস্যায় ভুগছে। পাশাপাশি, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও জ্বালানি ও ঔষধের অভাবে কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি।
এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা, “ইউএনডিপি” ও “ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম” (WFP) ত্রাণের জন্য সীমান্তে অপেক্ষমান রয়েছে। তবে সীমিত সংখ্যক ট্রাক প্রবেশ করতে পারায় তাদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাচ্ছে।
জিম্মি সমস্যা ও যুদ্ধবিরতির প্রভাব
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে, সোমবার হামাস ২০ জন জীবিত জিম্মি এবং চারজন মৃত জিম্মির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। তবে এখনও ২৪ জনের মরদেহ গাজায় আটকা আছে। হামাস পূর্বে জানিয়েছিল যে, কিছু জিম্মির মরদেহের সন্ধান হারিয়ে গেছে। তাদের দাবি, যারা মরদেহের অবস্থান জানতেন তাদের হত্যা করা হয়েছে বা আক্রমণের কারণে স্থানের নকশা পরিবর্তিত হয়েছে।
হামাস জানিয়েছে, জিম্মির মরদেহ খুঁজে বের করতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তারা তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করেছে। এই দল সম্ভাব্য অবস্থানগুলোতে মরদেহের খোঁজ করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি বিধিনিষেধ ও ত্রাণ প্রবেশে বাধার কারণে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্ষোভ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ ইসরায়েলকে ত্রাণ প্রবেশে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘের মান মানবিক ত্রাণ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, “গাজা উপত্যকায় মানুষ আগুনের রেখায় বসবাস করছে। সেখানে প্রতিটি দিন মৃত্যুর ঝুঁকি বহন করছে। আন্তর্জাতিক সমাজকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং ত্রাণ পৌঁছানোর পথ নিশ্চিত করতে হবে।”
ত্রাণ ও জনজীবনের বাস্তব চিত্র
বর্তমানে গাজায় খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট সবচেয়ে প্রভাব ফেলছে। UNICEF এবং WHO-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুদের অর্ধেকের বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সংকটের কারণে কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলি খাদ্য, পানি, ঔষধ, এবং ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তবে প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাধা এবং রাজনৈতিক জটিলতা তাদের কার্যক্রমকে সীমিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার জনগণ যদি আগামী কয়েক সপ্তাহে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পায়, তবে মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছাবে।
গাজার মানুষদের ভয় ও নিরাপত্তা সমস্যা
ত্রাণ সীমিত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। গাজার নাগরিকরা খাবার, পানি ও ঔষধের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের কারণে হাসপাতালগুলোও কার্যক্রমে সীমিত। স্থানীয়রা বলছে, “আমরা শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি। ত্রাণ না এলে আমরা বাঁচতে পারব না।”
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যদি আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা না হয়, তবে গাজার মানুষদের জন্য মানবিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া, রাফাহ ক্রসিং খোলার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি।
জাতিসংঘ, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলো ইতিমধ্যে রাফাহ ক্রসিং খোলার জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তাদের মতে, রাজনৈতিক জিম্মি সমস্যার কারণে জনগণকে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।
গাজার মানুষরা মানবিক ত্রাণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাফাহ ক্রসিং খোলার বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি মানবিক দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক সমাজের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও ত্রাণ সরবরাহের নিশ্চয়তা ছাড়া গাজার মানুষদের জীবন হুমকির মুখে থাকবে। আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলের পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া গাজার মানুষের জীবনমানের ওপর নির্ধারক প্রভাব ফেলবে।
MAH – 13321 I Signalbd.com