
বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির খসড়া অবস্থানপত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার এই অবস্থানপত্র প্রেরণ করা হয়। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনা শীঘ্রই শুরু করার জন্য অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, “আমরা আশাবাদী শিগগিরই ওয়াশিংটন থেকে আলোচনায় ডাকা হবে এবং সেখানে তৃতীয় দফার আলোচনা শুরু হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই দফার আলোচনার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের ব্যাপারে ইতিবাচক ফল আশা করছি।”
অবশ্যই, আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে শুল্ক হার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, অ-শুল্ক বিষয়াদি ও নিরাপত্তা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এর ফলে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবধান ধীরে ধীরে কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই বাণিজ্য উপদেষ্টা আমেরিকান অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে বৈঠক করেছেন
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও জুতা আমদানিকারক সংস্থা এএএফএ-এর সঙ্গে অনলাইন বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এএএফএ জানায়, যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের সঙ্গে এই ধরনের শুল্ক চুক্তি করেছে, কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে এখনো কোনও চুক্তি হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি ও বাংলাদেশের পাল্টা ব্যবস্থা
২০২৫ সালের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র মোট ৬০টি দেশের পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। তার মধ্যে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করা হয়। তবে পরে, তিন মাসের জন্য ওই শুল্ক স্থগিত রেখে ৮ জুলাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিঠি পাঠিয়ে এই হার কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করে দেন।
এরপর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দফায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক হলেও, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, সরকারের সঠিক সময়মত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সরকার অবশ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনাটি খুবই সুষ্ঠুভাবে এগোচ্ছে এবং উভয় পক্ষ প্রায় একমত অবস্থানে এসেছে।
অবস্থানপত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে সরকারি আপডেট
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, “অবস্থানপত্রের বিস্তারিত এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া বিষয় এবং বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখনই আলোচনা চলছে।” জুন ও জুলাইয়ে দুই দফায় আলোচনায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানো যায়নি।
গত ১২ জুন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এককভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা লুৎফে সিদ্দিকী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও যুক্ত করা হয়। তবে তারা কিছু সময় নষ্ট করেছেন বলে মনে করা হয়। এখন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রধান নেতৃত্বে আলোচনাগুলো এগিয়ে নিচ্ছেন।
বাণিজ্য বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্যের আমদানির উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত রোববার দুই দেশের মধ্যে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। গমের পাশাপাশি তুলা, সয়াবিন তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ইত্যাদি পণ্যও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি পরিমাণে আমদানি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
লবিস্ট নিয়োগের সম্ভাবনা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান গত সোমবার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি চলমান রাখতে লবিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, লবিস্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাতদিন সময় লাগতে পারে। দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ইতোমধ্যেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী এই বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “লবিস্ট কোনো একটি সংগঠনের জন্য কাজ করবে না, এটি কাজ করবে দেশের স্বার্থে। লবিস্ট নিয়োগ করতে হলে সরকারের অনুমোদন আবশ্যক। তবে বর্তমানে এনডিএ থাকার কারণে সরকার সম্ভবত লবিস্ট নিয়োগে সম্মত হবেন না। তাই এ বিষয়ে খুব বেশি আশা করা যায় না।”
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক হতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, জুতা ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মার্কিন বাজারের সুযোগ বাড়লে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে। তবে শুল্ক, শ্রম আইন, পরিবেশ রক্ষা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং, সরকারের সুসংগঠিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সকল পক্ষের সহযোগিতা অপরিহার্য।
সামগ্রিক বিশ্লেষণ ও পরবর্তী ধাপ
বর্তমানে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাগুলো প্রধানত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে চলছে। ইতোমধ্যে অবস্থা অনুকূলে হলেও কিছু সময়ক্ষেপণের কারণে ব্যাপক অগ্রগতি অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের আশা, দ্রুত তৃতীয় দফার আলোচনায় দেশের স্বার্থ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।
একই সঙ্গে, লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে সরকারের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মার্কিন রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরিসরে লবিস্টদের প্রভাব অনেক বেশি। তবে এনডিএ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় এই প্রক্রিয়া জটিলতায় পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি দেশটির অর্থনীতির জন্য এক বড় সাফল্য হবে। বাণিজ্য বাড়ানো, আমদানি-রপ্তানিতে সুবিধা বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণের জন্য দরকার কার্যকর ও সুসংগঠিত কৌশল। সরকার ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করে এই চুক্তি সফল করতে হবে, যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে আসে।