বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘শেষ পর্যন্ত লড়াই’ করার হুঁশিয়ারি চীনের

Advertisement

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর বেইজিং কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাণিজ্য যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়, তবে চীনও ‘শেষ পর্যন্ত লড়বে’। তবে একই সঙ্গে আলোচনার দরজাও খোলা রাখার বার্তা দিয়েছে তারা।

এই ঘোষণার পর বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

ট্রাম্পের ঘোষণা ও নতুন বাণিজ্য উত্তেজনা

গত সপ্তাহে চীন বিরল খনিজ বা রেয়ার আর্থ উপাদানের রফতানি নিয়ন্ত্রণে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর পরপরই ট্রাম্প প্রশাসন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়।

শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেন, “চীন নিয়মিত শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করছে। তারা বৈশ্বিক বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আর চুপ থাকবে না।”

তিনি আরও জানান, ১ নভেম্বরের মধ্যে সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি পণ্যের ওপর নতুন রফতানি নিয়ন্ত্রণ জারি করা হবে। এর ফলে শুল্কবৃদ্ধি কার্যকর হবে বর্তমান ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার নয় দিন আগে থেকেই।

চীনের কড়া প্রতিক্রিয়া: “আপনি যদি লড়াই চান, আমরা লড়ব”

মঙ্গলবার বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “শুল্ক যুদ্ধ এবং বাণিজ্য যুদ্ধের বিষয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত। আপনি যদি লড়াই করতে চান, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব। কিন্তু আপনি যদি আলোচনা চান, আমাদের দরজা সবসময় খোলা।”

তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একদিকে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করছে, আবার অন্যদিকে আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছে। এটি দ্বৈত মানসিকতা এবং সঠিক কূটনৈতিক আচরণ নয়।”

চীন মনে করছে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ কেবল দুই দেশের মধ্যে নয়, পুরো বিশ্ববাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিরল খনিজ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের পটভূমি

রেয়ার আর্থ বা বিরল মৃত্তিকা পদার্থ বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। বিশ্বের মোট রেয়ার আর্থ সরবরাহের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে।

গত সপ্তাহে চীন এই খনিজ পদার্থের রফতানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বেইজিংয়ের দাবি, এটি তাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অংশ। তবে ওয়াশিংটন মনে করছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিখাতে চাপ সৃষ্টি করার কৌশল।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসনও পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নেয়। ফলে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে।

বিশ্ববাজারে প্রভাব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির এই বিরোধের প্রভাব সরাসরি পড়েছে বৈশ্বিক শেয়ার ও পণ্যবাজারে। ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই এশীয় বাজারে শেয়ারমূল্য কমে যায়, এবং মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারও নিম্নমুখী হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়তে পারে। ফলে ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল ও প্রতিরক্ষা শিল্পে কাঁচামালের সংকট দেখা দিতে পারে।

চীনা বাণিজ্য বিশ্লেষক লি ঝাং বলেন, “এই সংঘাত যদি আরও বাড়ে, তাহলে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।”

আলোচনার সম্ভাবনা ও কূটনৈতিক বার্তা

যদিও উভয় দেশই কঠোর অবস্থানে রয়েছে, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে আলোচনার দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বেইজিং বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে আলোচনা চায়, তবে চীন প্রস্তুত।

দক্ষিণ কোরিয়ায় আসন্ন ট্রাম্প-শি জিনপিং বৈঠক নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকটি নির্ধারিত সময় অনুযায়ী না-ও হতে পারে, যদি শুল্কবৃদ্ধি কার্যকর হয়।

তবে ট্রাম্পও পরে এক পোস্টে নরম সুরে বলেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা চীনকে সহায়তা করতে চাই, কিন্তু আমাদের স্বার্থ রক্ষাও জরুরি।”

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রবার্ট ফিশার মনে করেন, “চীন এখন দেখাতে চায় যে তারা নীতিগতভাবে পিছু হটবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে পিছু হটতে পারছে না। ফলে এই লড়াই দীর্ঘ হতে পারে।”

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ফারহানা রহমান বলেন, “চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই বিরোধ কেবল অর্থনীতিতে নয়, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা খাতেও প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এ সংঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। একদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্কনীতি, অন্যদিকে চীনের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া—উভয়েই এখন অবস্থান নিচ্ছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়।

বিশ্ব অর্থনীতি এখন তাকিয়ে আছে—আলোচনার পথ খোলা থাকবে, নাকি এই সংঘাত সত্যিই “শেষ পর্যন্ত লড়াই”-এর দিকে গড়াবে।

এম আর এম – ১৭৭১,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button