ট্রাম্পের মন্তব্যে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গড়ার ঘোষণা থাকলেও উপেক্ষিত ফিলিস্তিন প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর নেতৃত্বেই গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটেছে এবং এর মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে এক ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের যুগ’। তবে তাঁর বক্তব্যে ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
গাজা যুদ্ধবিরতির সাফল্যের দাবি ট্রাম্পের
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর ঘিরে রাজনৈতিক আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সোমবার ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেন তিনি এবং পরে মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত ‘শান্তি সম্মেলনে’ যোগ দেন। সেখানে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ট্রাম্প বলেন, “এটি সন্ত্রাস ও মৃত্যুর যুগের অবসান। আজ থেকে শুরু হলো বিশ্বাস ও শান্তির নতুন যুগ।”
তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক উদ্যোগেই গাজায় যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। তাঁর ভাষায়, “এই সমঝোতা স্থায়ী শান্তির দরজা খুলে দিয়েছে এবং এটি এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর।”
তবে সমালোচকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই “নতুন মধ্যপ্রাচ্য” ধারণায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা দখলদারিত্বের অবসান— এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।
নেসেটে হট্টগোল, ফিলিস্তিন প্রশ্নে নীরবতা
ইসরায়েলের নেসেটে ট্রাম্পের ভাষণ চলাকালে ফিলিস্তিনপন্থী আইনপ্রণেতা আয়মান ওদেহ “জেনোসাইড” লেখা কাগজ তুলে ধরলে সভায় হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ওই সময় কয়েক মিনিটের জন্য ট্রাম্পের বক্তব্য থেমে যায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে তিনি পুনরায় ভাষণ শুরু করেন।
তবে পুরো ভাষণজুড়ে ফিলিস্তিনের ওপর চলমান ইসরায়েলি দখল, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, কিংবা গাজার ওপর নিষেধাজ্ঞার মতো ইস্যুগুলোর কোনো উল্লেখ ছিল না। ট্রাম্প কেবল সংক্ষিপ্তভাবে বলেন, “গাজার জনগণ এখন উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।” এই বক্তব্যকে অনেকেই ‘প্রচলিত মার্কিন নিরপেক্ষতার মুখোশ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা’— কিন্তু কার জন্য?
ট্রাম্প তাঁর ভাষণে একাধিকবার “নতুন মধ্যপ্রাচ্য” শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “এই সমঝোতার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হবে।”
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি যেমনই হোক না কেন, ফিলিস্তিন প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কোনো সমাধান স্থায়ী হতে পারে না। ইসরায়েল যদি দখলদারিত্ব বজায় রাখে এবং ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার না দেয়, তবে এই তথাকথিত নতুন মধ্যপ্রাচ্য কেবলমাত্র কূটনৈতিক বিভ্রম হিসেবেই দেখা দেবে।
ইসরায়েলি সমাজকর্মী হানান আশরাওই বলেছেন, “যে শান্তিতে ন্যায়বিচার নেই, তা কখনো স্থায়ী হয় না। ট্রাম্পের এই শান্তি-চুক্তি ইসরায়েলকেন্দ্রিক, আরব বিশ্ব নয়।”
বন্দিবিনিময় ও মানবিক বাস্তবতা
একই দিনে গাজায় বন্দিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। হামাস জীবিত ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মি ফেরত দেয়, এবং ইসরায়েল মুক্তি দেয় ১,৯৬৮ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে। এই বন্দিবিনিময় যুদ্ধবিরতির অন্যতম শর্ত হিসেবে দেখা হয়।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ইসরায়েলের কারাগারে বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চলেছে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত সাংবাদিক আলা–রিমায়ি বলেছেন, “ইসরায়েলি কারাগারে আমাদের অনাহারে রাখা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। আমি দুই বছরে ৫০ কেজি ওজন হারিয়েছি।”
এই বাস্তবতা দেখায়, যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাইরেও মানবিক সংকট গভীর রয়ে গেছে।
নেতানিয়াহুর প্রশংসা ও রাজনৈতিক বার্তা
ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে “সময়ের সেরা যুদ্ধকালীন নেতা” বলে অভিহিত করেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, “নেতানিয়াহু বহুবার আমাকে ফোন করে অস্ত্র চেয়েছেন, আমরা তাকে সেই সহায়তাই দিয়েছি।”
এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে ব্যাপক অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে— যা গাজায় গণহত্যার দায়ভার থেকে মার্কিন প্রশাসনকে মুক্ত করে না।
ট্রাম্প আরও বলেন, “বিশ্ব এখন ইসরায়েলকে ভালোবাসছে।” কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের বহু দেশ সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা ইসরায়েলের প্রতি বৈশ্বিক বিরূপতা নির্দেশ করে।
ইরান ইস্যুতে মিশ্র বার্তা
ইরান প্রসঙ্গেও ট্রাম্প দ্বৈত অবস্থান নেন। একদিকে তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি “ধ্বংস” হয়েছে; অন্যদিকে বলেন, আলোচনার দরজা এখনও খোলা।
তিনি বলেন, “আমি চাই ইরান এগিয়ে আসুক। নিষেধাজ্ঞাগুলো খুব কঠিন, তবে আলোচনায় বসলে তা তুলে নেওয়া হবে।”
এই মন্তব্যকে পর্যবেক্ষকরা মার্কিন কূটনীতির “অর্থনৈতিক চাপ ও কৌশলগত ছাড়”–এর একটি উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।
বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে ‘শান্তি সম্মেলন’
শারম আল শেখের শান্তি সম্মেলনে ২৮টি দেশের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার নেতারাও সেখানে যোগ দেন।
ট্রাম্প এই উপস্থিতিকে “বিশ্বের সমর্থনের প্রতীক” বলে বর্ণনা করেন এবং মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতাকে ধন্যবাদ জানান।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সম্মেলন মূলত ইসরায়েলকেন্দ্রিক সমঝোতাকে বৈধতা দেওয়ার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল। ফিলিস্তিনপন্থী দেশগুলো এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ফিলিস্তিন প্রশ্ন উপেক্ষিত থাকায় উদ্বেগ বাড়ছে
যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় মানবিক সংকট, পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান, ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির কোনো অগ্রগতি না থাকায় পরিস্থিতি অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
আরব বিশ্লেষকরা বলছেন, “যে কোনো শান্তি চুক্তি তখনই সফল হয়, যখন তা দখলদারিত্বের অবসান ঘটায়।”
ফিলিস্তিনের জনগণ এখনো তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত, আর এই নীরবতা ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ ধারণাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের “নতুন মধ্যপ্রাচ্য” ঘোষণায় কূটনৈতিক উচ্ছ্বাস থাকলেও বাস্তবতার মাটিতে সেটি এখনো ফিলিস্তিনবিহীন এক সমীকরণ। বিশ্লেষকদের মতে, যতদিন ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্র স্বীকৃতি নিশ্চিত না হবে, ততদিন কোনো যুদ্ধবিরতিই স্থায়ী শান্তি আনতে পারবে না।
প্রশ্ন এখন একটাই— “এই নতুন মধ্যপ্রাচ্য আসলে কার জন্য?”
এম আর এম – ১৭৬৮,Signalbd.com