বিশ্ব

ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে গাজায় যাচ্ছেন গ্রেটা থুনবার্গ

Advertisement

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক তরুণ কণ্ঠস্বরের নাম গ্রেটা থুনবার্গ। এবার তিনি যুক্ত হচ্ছেন এক মানবিক অভিযানে, যার লক্ষ্য অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সহায়তা পৌঁছানো এবং সেখানে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলা। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) উদ্যোগে আয়োজিত এই যাত্রায় তিনি যুক্ত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরও কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিকের সঙ্গে।

মানবিক জাহাজে গাজা অভিমুখে

আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, আগামী রোববার ইতালির সিসিলি দ্বীপের কাতানিয়া বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করবে ফ্রিডম ফ্লোটিলার মানবিক সহায়তা জাহাজ। এই জাহাজের যাত্রী হিসেবে থাকবেন সুইডেনের পরিবেশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’-এর অভিনেতা লিয়াম কানিংহাম, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য রিমা হাসান, ফিলিস্তিনি-মার্কিন মানবাধিকার আইনজীবী হুওয়াইদা আরাফসহ আরও অনেকে। তারা সবাই গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাতেই এ যাত্রায় শামিল হচ্ছেন।

ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ভাষ্যমতে, এটি শুধু একটি মানবিক সহায়তা জাহাজ নয়; বরং এটি প্রতীকী প্রতিবাদের এক শক্তিশালী মাধ্যম, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক অবরোধ এবং গাজায় চলমান দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করাই এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য।

অবরুদ্ধ গাজা: মানবিক সংকটের চরম রূপ

গত ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অবরোধে গাজা ভূখণ্ড কার্যত এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। খাবার, পানি, চিকিৎসাসেবা ও বিদ্যুৎসহ সব ধরনের মৌলিক পরিষেবার অভাবে জীবনধারণই হয়ে পড়েছে কষ্টকর। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে শত শত মানুষ সেখানে নিহত ও আহত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলো কার্যত অচল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং অধিকাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ইসরায়েলের ধারাবাহিক অবরোধ ও বিমান হামলার ফলে জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মানবিক সহায়তা পৌঁছানোও প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে ইসরায়েলি বাহিনী, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী সরাসরি লঙ্ঘন।

ফ্রিডম ফ্লোটিলা: প্রতিরোধের প্রতীক

২০১০ সালে ফ্রিডম ফ্লোটিলা প্রথম বিশ্বে আলোচনায় আসে, যখন তুরস্ক থেকে গাজাগামী এমভি মারমারা নামক মানবিক জাহাজে ইসরায়েলি নৌবাহিনী হামলা চালায় এবং ১০ জন তুর্কি কর্মী নিহত হন। সেই থেকেই ফ্রিডম ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের জন্য এক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে এই জোটটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানবিক সহায়তা নিয়ে গাজামুখে যাত্রার পরিকল্পনা করে থাকে। এবারের মিশনটি হচ্ছে ২০২৫ সালে সংগঠনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও উচ্চপ্রতিষ্ঠিত অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে পরিচালিত এক বিশেষ অভিযান।

গ্রেটা থুনবার্গের অবস্থান

জলবায়ু আন্দোলনের জোরালো কণ্ঠ গ্রেটা থুনবার্গ এর আগে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি দায়বদ্ধতা দাবি করে পরিবেশগত এবং মানবিক সংকটের মধ্যে সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার ছাড়াই মানবিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’

এবার তিনি সরাসরি একটি মানবিক যাত্রায় যুক্ত হয়ে গাজায় নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন। এটি শুধু তাঁর আন্দোলনের একটি সম্প্রসারণ নয়, বরং বিশ্ব মানবতার এক নতুন সংহতির বার্তাও বহন করছে। তিনি বলেন, “গাজায় যা ঘটছে তা শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি একটি পরিকল্পিত মানবিক সংকট। আমাদের উচিত তা থামানো।”

প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভাষা

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান এই অভিযানের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে মানবিক অবরোধ এবং চলমান গণহত্যার নিন্দা জানানো, ইসরায়েল রাষ্ট্রকে দেওয়া দায়মুক্তির অবসান ঘটানো এবং আন্তর্জাতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।”

তিনি আরও জানান, এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও ইসরায়েল তাঁকে প্রবেশ করতে দেয়নি। এসব বাধা সত্ত্বেও তিনি নিজের অবস্থানে অনড় আছেন।

আগের হামলার অভিজ্ঞতা

এপ্রিলে ফ্রিডম ফ্লোটিলার একটি জাহাজ গাজা অভিমুখে রওনা দিয়েছিল, যাতে অংশ নেন গ্রেটা থুনবার্গসহ আরও কিছু মানবিক কর্মী। কিন্তু ওই জাহাজটিকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে অভিযানটি বাধাগ্রস্ত হয়। ফ্লোটিলা জোটের দাবি, এই হামলা ইসরায়েলি ড্রোন থেকে চালানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো প্রতিরোধ করা।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই যাত্রার খবরে বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে গাজায় মানবিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ফ্রিডম ফ্লোটিলার যাত্রাকে ‘প্ররোচনামূলক এবং নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

উপসংহার

গ্রেটা থুনবার্গের গাজা অভিমুখে যাত্রা কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, এটি একটি প্রতিশ্রুতি—বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। ফ্রিডম ফ্লোটিলার এই মানবিক অভিযান যদি সফল হয়, তাহলে এটি বিশ্বের সামনে নতুন করে একবার গাজার বাস্তবতা উন্মোচন করবে। আর যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবুও এই প্রতীকী প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক বিবেককে নাড়িয়ে দেবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button