বিশ্ব

ইরান স্থগিত করল জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি

Advertisement

ইরান জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি অস্থায়ীভাবে স্থগিত করেছে। এ তথ্য ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তার দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে এই পদক্ষেপ পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া হয়েছে এবং যদি ইরানের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়, তাহলে চুক্তিতে পুনরায় ফিরে আসা সম্ভব।

আরাগচি বলেন,

“সহযোগিতা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়নি, এটি কেবল অস্থায়ীভাবে স্থগিত। আমাদের অধিকার এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য যদি সমন্বিত প্রস্তাব আসে, আমরা পুনরায় চুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত।”

চুক্তি স্থগিত হওয়ার পেছনের কারণ

সংবাদমাধ্যম আরটি জানিয়েছে, এ বছরের জুনে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বোমা হামলার পরই ইরান সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী, IAEA সংস্থাটিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করার অনুমতি দেয়।

কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায় যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি—যারা ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী—ইরানের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করতে চায়। এই চেষ্টা চুক্তির কার্যকারিতা অনেকাংশে সীমিত করে।

আরাগচি আরও বলেন,

“বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার কোনো যৌক্তিকতা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তা।”

পশ্চিমা দেশের অভিযোগ এবং ইরানের প্রতিক্রিয়া

দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ তুলছে। অন্যদিকে ইরান এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছে। ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি পূর্ণতই বেসামরিক এবং তারা ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির অধীনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকার রাখে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান চুক্তি স্থগিতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করার পাশাপাশি জাতীয় সুরক্ষা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে চাইছে।

ট্রাম্প প্রশাসন এবং পারমাণবিক আলোচনা

এই বছরের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেছিল। তবে জুন মাসে ইরানের পারমাণবিক, সামরিক এবং আবাসিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরাইলি হামলা ঘটায়। এই ঘটনার পর আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়া ব্যর্থ হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান এখন আলোচনা পুনরায় শুরু করার আগে তার অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরানের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো আশঙ্কা করছে যে, ইরান যদি চুক্তি থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে যায়, তাহলে পারমাণবিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে ইরান তর্ক করছে, যে চুক্তির বর্তমান কাঠামো তার অধিকার সীমিত করছে, তাই সাময়িক স্থগিতকরণ প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাপী বিশ্লেষকরা ইরানের পদক্ষেপকে রক্ষণশীল কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখছেন। তারা মনে করেন, ইরান চুক্তি থেকে স্থায়ী বিচ্যুতি না করে আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর জন্য সাময়িক স্থগিতকরণ করেছে।

পারমাণবিক স্থাপনার পরিদর্শন ও নিরাপত্তা

IAEA-র চুক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর পরিদর্শন করে থাকে। ইরানের চুক্তি স্থগিত হওয়ায় এই পরিদর্শন কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে স্থগিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এই পদক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রতিফলন। তারা এটিকে আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে ইরানের কৌশলগত প্রতিরোধ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।

২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির প্রেক্ষাপট

২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করে দেয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করে। বদলে পশ্চিমা দেশগুলো সীমিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা প্রদান করেছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপ এবং ইসরাইলি হামলার ফলে চুক্তির কার্যকারিতা কমে যায়। ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চুক্তি সম্মানজনকভাবে প্রয়োগ না হলে তারা এর প্রতি অঙ্গীকার স্থগিত রাখতে বাধ্য।

ভবিষ্যতের কৌশল এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের পদক্ষেপ ভবিষ্যতের কূটনৈতিক আলোচনার জন্য দিশা প্রদান করবে। ইরান চাইছে, চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার আগে তার অধিকার এবং জাতীয় স্বার্থের পূর্ণ নিশ্চয়তা নিশ্চিত হোক।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এখন ইরানের ওপর। বিশেষ করে পারমাণবিক কর্মসূচি, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক এর দিকে। ইরান চাইছে, আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে সীমিতভাবে তার নীতি বজায় রাখা

ইরানের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। চুক্তি স্থগিত হওয়া মানে হচ্ছে, ইরান এখন তার জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তা রক্ষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করছে যে, চুক্তি পুনরায় কার্যকর করার আগে তার অধিকার ও শর্তসমূহ পূর্ণ করা জরুরি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের সাময়িক স্থগিতকরণ আন্তর্জাতিক কূটনীতি, পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এবং নিরাপত্তা কৌশলের একটি সমন্বয়মূলক ফলাফল। এটি প্রমাণ করে যে, ইরান তার নীতি ও স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক আলোচনা পুনরায় শুরু হলে চুক্তির কাঠামো আরও স্বচ্ছ ও সমন্বিত হতে হবে

ইরান ও জাতিসংঘের পারমাণবিক চুক্তি স্থগিত হওয়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক খবর নয়। এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতি, নিরাপত্তা, এবং পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ-এর দিকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ইরানের এই পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য একটি প্রগতিশীল ধাপ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

MAH – 13303 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button