বিশ্ব

ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা কি সত্যিই অসম্ভব

Advertisement

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ফরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি আজ বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা পারমাণবিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। টেহরানের দক্ষিণে, পবিত্র শহর কোমের কাছাকাছি পাহাড়ের গহীনে ৮০ থেকে ৯০ মিটার গভীরে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা এই স্থাপনা ব্যাপক নিরাপত্তা ও সুড়ঙ্গ নিয়ে ঘেরা।

সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট ছবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফরদোর গোপনীয়তা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এটি বায়ু হামলা দিয়ে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে রয়েছে পাঁচটি সুড়ঙ্গ, চারপাশে দৃঢ় নিরাপত্তা প্রাচীর, এবং প্রচুর আধুনিক যন্ত্রপাতি।

ফরদো পারমাণবিক স্থাপনার ইতিহাস ও গুরুত্ব

ফরদো স্থাপনাটি প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে জনসমক্ষে আসে, তখন থেকেই এর প্রকৃত লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক জল্পনা শুরু হয়। ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে উদ্ধার করা গোপন নথিপত্র ও তথ্য থেকে জানা যায়, ফরদোতে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ হয়, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে পারে।

২০০৯ সালের পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে উদ্বেগ তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নেতারা ২০০৯ সালে এক যৌথ বিবৃতিতে ফরদোর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন এবং বলেছিলেন, এই কেন্দ্রের আকার ও গঠন ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

ইরান ও ফরদোর পারমাণবিক কর্মসূচি

ইরান তেহরান বরাবর দাবি করে আসছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ, তবে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এর বিপরীতে সন্দেহ পোষণ করে আসছে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছে।

২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্ব শক্তির মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে ফরদোতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের হার এবং পরিমাণ সীমিত রাখা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ইরান আবার ফরদোয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে।

ফরদো কেন্দ্র ধ্বংস করা কতটা কঠিন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরদো স্থাপনার মূল কক্ষগুলো মাটির অন্তত ৮০-৯০ মিটার গভীরে অবস্থিত। এমন গভীরে এবং সুড়ঙ্গভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা অবস্থায় বায়ু থেকে কিংবা বিমান হামলা দিয়ে ধ্বংস করা অতি কঠিন।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রুসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফরদোর মতো শক্তিশালী সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনায় সফলভাবে আঘাত হানতে হলে প্রয়োজন হয় একাধিক শক্তিশালী বোমার একযোগে সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত।

ইসরায়েলের মার্কিন দূত ইয়েচিয়েল লেইটার বলছেন, “এমন শক্তিশালী বোমা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই আছে, এবং এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা যে, ফরদোতে আকাশ থেকে হামলা চালানো হবে কি না।”

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান ফরদোতে ইউরেনিয়ামের সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য উপযুক্ত ধাপ। আইএইএ’র ২০২৫ সালের মে মাসের রিপোর্টে বলা হয়, “ইরান এমন মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে যা খুবই উদ্বেগজনক।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিচ্ছে যাতে প্রয়োজনে দ্রুত অস্ত্র তৈরি করা যায়। আইএসআইএস নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, “ফরদোতে মাত্র ২৩৩ কেজি অস্ত্রমান ইউরেনিয়াম তিন সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব, যা ৯টি পারমাণবিক বোমার জন্য যথেষ্ট।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি

পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসা এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা বজায় রাখতে বিভিন্ন কূটনৈতিক ও সামরিক বিকল্প ভাবছে।

তবে আইএইএ সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে এবং নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এই কেন্দ্রের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত পারমাণবিক কেন্দ্র। এর অবস্থান, গভীরতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা এটিকে বায়ু হামলা থেকে প্রায় অক্ষত রাখে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন, ইরানের দাবি ও কার্যক্রম নিয়ে সংশয় রয়েছে, কিন্তু এর সঠিক বাস্তবতা নিয়েও বিতর্ক অব্যাহত।

বিশ্বের নানা দেশের কূটনীতিক, সামরিক ও বিজ্ঞানীরা ফরদোর অস্তিত্ব এবং এর কার্যক্রম নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছেন। সামরিক অপারেশন, কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button