
তোরখাম ও চামানসহ সব প্রধান সীমান্ত বন্ধ, দুই দেশের সম্পর্ক আবারও সংকটে
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সংঘর্ষের পর আবারও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। শনিবার গভীর রাতে সীমান্ত চৌকিগুলোতে দু’পক্ষের গোলাগুলির পর রোববার সকালে পাকিস্তান সরকার হঠাৎ ঘোষণা দেয়—আফগানিস্তানের সঙ্গে সব সীমান্তপথ আপাতত বন্ধ থাকবে।
এই পদক্ষেপের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাণিজ্য, জনসাধারণের যাতায়াত ও সীমান্তপারের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে।
সীমান্তে সংঘর্ষের সূত্রপাত
পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, শনিবার রাতের দিকে আফগান সেনারা পাকিস্তানের সীমান্ত চৌকির দিকে গুলি চালায়। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, এই আক্রমণ ছিল “প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ”, যা গত সপ্তাহে আফগান ভূখণ্ডে পাকিস্তানের বিমান হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে করা হয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জানায়, আফগানিস্তান প্রথমে গুলি চালানো শুরু করায় তারা পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়। একাধিক সীমান্ত চৌকি লক্ষ্য করে ভারী অস্ত্র ও মর্টার হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের পাল্টা হামলায় আফগান সীমান্তের অন্তত তিনটি চৌকি ধ্বংস হয়েছে।
সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা
রোববার সকালে ইসলামাবাদ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, আফগানিস্তানের সঙ্গে সব সীমান্ত পারাপার আপাতত বন্ধ থাকবে।
এর মধ্যে প্রধান দুটি বাণিজ্যপথ — তোরখাম (খাইবার পাখতুনখাওয়া) ও চামান (বেলুচিস্তান) — সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ছোট তিনটি পারাপার পথ — খারলাচি, আঙ্গুর আড্ডা ও গুলাম খান — সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী বাহিনী (FC) জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওই অঞ্চলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের বরাতে জানা গেছে, কুররম অঞ্চলে এখনও থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে বড় কোনো সংঘর্ষের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
কাবুলের নীরবতা ও তালেবান সরকারের প্রতিক্রিয়া
কাবুল এখন পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শনিবার গভীর রাতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, তাদের “সীমিত সামরিক অভিযান” মধ্যরাতের পর শেষ হয়েছে।
আজ রবিবার সকালে তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন,
“আফগানিস্তানের কোনো অংশেই এখন কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি নেই। আমাদের সেনারা নিজেদের সীমানার মধ্যেই অবস্থান করছে।”
তিনি আরও দাবি করেন, পাকিস্তানের অভিযোগগুলো “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” এবং ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযথা হস্তক্ষেপ করছে।
২,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত
স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৬০০ কিলোমিটার (প্রায় ১,৬০০ মাইল)। দীর্ঘ এই সীমান্তের অধিকাংশ অংশে পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকা থাকায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে, তালেবান প্রশাসন পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–কে আশ্রয় দিচ্ছে। এই সংগঠন পাকিস্তানের ভেতরে বহুবার হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের দাবি, এই জঙ্গিদের অনেকেই ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনিক স্থাপনায় হামলা চালায়।
তবে কাবুল এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। তালেবান সরকার বলেছে, আফগান মাটিকে অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে “ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।”
বিমান হামলার অভিযোগ ও প্রতিশোধমূলক অভিযান
কাবুলের তরফে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আফগান ভূখণ্ডে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়।
তালেবান প্রশাসনের মতে, এই বিমান হামলায় কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক হতাহত হন। পাকিস্তান অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার কথা অস্বীকার করেছে।
কিন্তু পাকিস্তানি নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডন নিউজ জানায়, ওই হামলার লক্ষ্য ছিল টিটিপি নেতা মোল্লা ফজলুল্লাহ গ্রুপের এক উচ্চপর্যায়ের কমান্ডার। তিনি নিহত হয়েছেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
এই ঘটনার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা রবিবার সীমান্ত বন্ধের মধ্য দিয়ে এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে।
বাণিজ্য ও মানবিক প্রভাব
তোরখাম ও চামান সীমান্ত শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন শত শত ট্রাক খাদ্যপণ্য, ফলমূল, সিমেন্ট ও জ্বালানি বহন করে এই পথ দিয়ে দুই দেশে যাতায়াত করে।
সীমান্ত বন্ধের কারণে এখন এসব পণ্যবাহী ট্রাক সীমান্তের দুই পাশে আটকে পড়েছে। বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো বলছে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজারো ব্যবসায়ী ও শ্রমিক।
পাকিস্তানের খাইবার চেম্বার অব কমার্স জানিয়েছে,
“দুই দেশের বাণিজ্য বন্ধ থাকলে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, মানবিক সংকটও দেখা দিতে পারে। বহু আফগান নাগরিক প্রতিদিন চিকিৎসা, খাদ্য বা ব্যবসার কারণে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন।”
অন্যদিকে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক পরিবার তাদের জীবিকার জন্য পাকিস্তান সীমান্ত নির্ভরশীল। সীমান্ত বন্ধ থাকায় তাদের দৈনন্দিন জীবন এখন স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক কয়েক মাস ধরেই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কূটনৈতিক মহলও সীমান্তের সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, দুই দেশের মধ্যে এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন এক নিরাপত্তা সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক রাহিমউল্লাহ ইউসুফজাই বলেন,
“পাকিস্তান চায় তালেবান প্রশাসন টিটিপি দমন করুক, কিন্তু তালেবান সেই পদক্ষেপ নিতে রাজি নয়। এ কারণেই সীমান্তে এই সংঘর্ষগুলো ঘটছে।”
অন্যদিকে কাবুলের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মুহাম্মদ হারুন শারিফ মনে করেন,
“দুই দেশই যদি আলোচনার টেবিলে না আসে, তবে এই সীমান্ত সমস্যা ভবিষ্যতে বড় আকার ধারণ করতে পারে।”
অতীতের উত্তেজনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
এটাই প্রথম নয় যে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এমন সংঘর্ষ হয়েছে। এর আগেও ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তোরখাম সীমান্তে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে উভয় পক্ষের সেনা নিহত হয়।
তবে এবারের ঘটনা অনেক বেশি বিস্তৃত এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। কারণ, এই সময়ে পাকিস্তানের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটও বিরাজ করছে।
ইসলামাবাদে ক্ষমতাসীন সরকার দেশীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে বিদেশনীতি নিয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, যা কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করছে।
আগামীর সম্ভাবনা
দুই দেশের সীমান্ত বন্ধ থাকায় ইতিমধ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যা প্রয়োজন, তাই করা হবে।”
অন্যদিকে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, তারা আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায়।
তবে মাটির বাস্তবতা বলছে—দুই দেশের সীমান্তে এখন উত্তেজনা চরমে, এবং পরিস্থিতি যে কোনো সময় আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর দীর্ঘদিনের অস্থিরতা আবারও নতুন করে জেগে উঠেছে।
গোলাগুলির পর সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং দুই দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে বড় প্রভাব ফেলবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন নজর রাখছে—দুই দেশ কি আবারও আলোচনায় ফিরবে, নাকি এই উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে?
MAH – 13286 I Signalbd.com