
দুই দেশের মধ্যে বাড়ছে উত্তেজনা, সীমান্তে ভারী অস্ত্রের ব্যবহার
২০২৫ সালের ১১ অক্টোবর শনিবার রাতে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সেনারা। আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান, যাদের বিশ্বে সাধারণত ‘তালেবান সরকার’ নামে চেনা হয়, তারা জানিয়েছে— পাকিস্তানের বিমান হামলার জবাবেই তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে।
আফগান সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় আমাদের সীমান্তরক্ষীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সংঘর্ষ এখনও চলছে এবং পরিস্থিতি উত্তপ্ত।”
এই হামলার ফলে দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের খোস্ত, পাকতিকা ও নানগারহার প্রদেশে গুলিবিনিময়, মর্টার হামলা এবং রকেট নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
পাকিস্তানের বিমান হামলা: ঘটনার সূত্রপাত
সংঘর্ষের শুরু হয় গত শুক্রবার রাতে (১০ অক্টোবর ২০২৫), যখন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ও খোস্ত প্রদেশের কয়েকটি স্থানে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান দাবি করে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)— যারা আফগান সীমান্ত থেকে পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আহসান হাফিজ বলেন, “টিটিপির সন্ত্রাসীরা আফগান মাটিকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে। আমরা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছি।”
তবে আফগান সরকার এই দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “পাকিস্তান আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আফগানিস্তান কোনো বিদেশি শক্তিকে তার ভূখণ্ডে হামলা চালাতে দেবে না।”
আফগানিস্তানের পাল্টা জবাব
শনিবার রাতে আফগান সীমান্তরক্ষীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত চৌকিগুলিতে হামলা চালায়। সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, শত শত আফগান সামরিক যান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, “রাতভর গোলাগুলি চলেছে, মেশিনগানের গর্জন ও বিস্ফোরণের শব্দে সীমান্তের গ্রামগুলো কেঁপে উঠেছে।”
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আমরা সীমান্ত থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে থাকি। গতরাতে পুরো আকাশ আলোয় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।”
মানবিক পরিস্থিতি ও উদ্বেগ
এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ জন নিহত এবং ৪০ জন আহত হয়েছে বলে আফগান সংবাদমাধ্যম টোলোনিউজ জানিয়েছে। পাকিস্তানের দিক থেকেও ৭ জন সেনা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যদিও পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
সীমান্তের উভয় পাশে শত শত পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশের কয়েকটি গ্রামে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।
আফগান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, “আমরা সংঘর্ষপূর্ণ এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু গোলাগুলির কারণে প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাস ও উত্তেজনার মূল কারণ
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই টানাপোড়নের মধ্যে রয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত— ডুরান্ড লাইন— ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশরা নির্ধারণ করেছিল, যা আফগানিস্তান কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। ফলে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আজও চলমান।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তান আশা করেছিল যে, আফগানিস্তানের নতুন সরকার তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং টিটিপি দমন করবে। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটি ঘটেছে। টিটিপি ক্রমে পাকিস্তানে হামলা বাড়িয়েছে, এবং ইসলামাবাদ দাবি করছে, তারা আফগান মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে।
এদিকে আফগান সরকার বলছে, পাকিস্তান সীমান্তে বারবার গোলাগুলি ও বিমান হামলা চালিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক বলেন, “আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয় দেশের উচিত শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা।”
অন্যদিকে চীন ও ইরানও এই সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বেইজিং বলেছে, “দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।”
সামরিক বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনও কম, তবে সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে বড় আকারের সঙ্কট তৈরি হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন,
“এটি শুধু সীমান্ত সংঘর্ষ নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক অবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তান চায় আফগানিস্তান টিটিপিকে দমন করুক, কিন্তু আফগান সরকার তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।”
স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগ
সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই এই সংঘর্ষের শিকার। তারা বলছে, রাজনীতি আর কূটনীতির লড়াইয়ের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
খোস্ত প্রদেশের বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন,
“আমরা কৃষক মানুষ। আমাদের কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে যায়, সন্তানরা ভয়ে কাঁপে।”
ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, যদি দুই দেশ দ্রুত সংযম না দেখায়, তবে এটি বড় আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। আফগানিস্তানে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট চরমে, তার মধ্যে নতুন এই উত্তেজনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
পাকিস্তানও বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যস্ত। সীমান্তে আরেকটি যুদ্ধ তাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি দুই দেশের জন্যই বিপজ্জনক এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি। আন্তর্জাতিক মহল সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানালেও মাটিতে যুদ্ধের শব্দ এখনও থামেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের এই সীমান্ত সংঘর্ষ কেবল দুই দেশের নয়— এটি গোটা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
MAH – 13276 I Signalbd.com