
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমছে না। যুদ্ধবিরতির সময়েই লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে নিহত হয়েছেন একজন এবং আহত হয়েছেন অন্তত কয়েকজন।
গাজা যুদ্ধবিরতির পরও উত্তেজনা থামেনি
গাজায় বহুদিনের সংঘাত শেষে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় বিশ্বজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছিল। কিন্তু সেই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। যুদ্ধবিরতির ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই ইসরায়েল নতুন করে হামলা চালিয়েছে প্রতিবেশী দেশ লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে। এই ঘটনাকে ঘিরে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গন।
লেবাননের স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকেলে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সিদন জেলার আল-নাজারিয়াহ গ্রামে টার্গেটেড হামলা চালায়। লেবাননের সরকারি সূত্র এবং স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন। হামলার পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।
ইসরায়েলের দাবি: হিজবুল্লাহর ঘাঁটি ছিল লক্ষ্য
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর সামরিক ঘাঁটি ও অবকাঠামো। তাদের দাবি, হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতির সুযোগে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছিল। সেই প্রস্তুতি নস্যাৎ করতেই এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
তেলআবিবের মতে, ওই এলাকায় হিজবুল্লাহ সদস্যরা অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম মজুত করছিল। এ ছাড়া সীমান্তে সামরিক নজরদারি বাড়ানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, এ ধরনের কার্যক্রম যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করছে।
লেবাননের পক্ষের দাবি: বেসামরিক এলাকায় হামলা
অন্যদিকে লেবাননের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হামলার স্থানটি ছিল একটি বাণিজ্যিক এলাকা, যেখানে নির্মাণ সরঞ্জাম বিক্রির প্রদর্শনী চলছিল। সেখানে হিজবুল্লাহর কোনো সামরিক ঘাঁটি ছিল না বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নিহত ব্যক্তি একজন সিরীয় নাগরিক। আহতদের মধ্যে ছয়জন লেবানিজ ও আরও একজন সিরীয় নাগরিক রয়েছেন। বিস্ফোরণে নিকটস্থ ভবন ও দোকানপাটে আগুন ধরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৈরুতের সঙ্গে দক্ষিণ লেবানন সংযোগকারী প্রধান মহাসড়কের একটি অংশও।
হিজবুল্লাহ পরিচালিত আল-মানার টিভি চ্যানেলে হামলার ভিডিওচিত্র সম্প্রচার করা হয়েছে, যেখানে আগুনে জ্বলতে থাকা ভবন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে উত্তেজনার ইতিহাস
লেবানন ও ইসরায়েলের সীমান্ত বহু বছর ধরেই অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের পর থেকে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিত।
২০২৪ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির একটি সমঝোতা হয়। কিন্তু তারপরও ইসরায়েল একাধিকবার সীমান্তে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ লেবাননের। হিজবুল্লাহও পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করেছে কয়েক দফায়। ফলে যুদ্ধবিরতি বাস্তবে কখনোই পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হলে এর প্রভাব পুরো অঞ্চলে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা ইসরায়েল ও লেবানন উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান শান্তি প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করতে পারে। এতে লেবানন সীমান্তে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে সিরিয়া ও ইরানের মতো দেশও এতে জড়াতে পারে, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েলের আঞ্চলিক নিরাপত্তা উদ্বেগ এখনো দূর হয়নি। হিজবুল্লাহর উপস্থিতি এবং ইরানের প্রভাব ইসরায়েলকে ক্রমাগত অস্বস্তিতে রাখছে। ফলে সীমান্তের ছোটখাটো ঘটনা বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে যেকোনো সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব রহমান বলেন, “ইসরায়েল এখন এক ধরনের ‘প্রতিরোধমূলক কৌশল’ নিচ্ছে। কিন্তু এমন হামলা শান্তি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয় এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়ায়।”
তিনি আরও বলেন, “লেবানন কিংবা গাজা — উভয় অঞ্চলেই এখন সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিরতির সুফল পাচ্ছে না। বরং তাদের জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।”
গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন আশার আলো দেখা দিয়েছিল, তখন লেবাননে ইসরায়েলের এই বিমান হামলা সেই আশায় কালো ছায়া ফেলেছে। দুই দেশের মধ্যকার আস্থা ও শান্তি পুনর্গঠনের পথ এখন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উভয় পক্ষ যদি সংযম না দেখায়, তাহলে এই সংঘাত দ্রুতই বৃহত্তর আকার নিতে পারে। যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব এখন মূলত নির্ভর করছে পরবর্তী কয়েক দিনের কূটনৈতিক পদক্ষেপের ওপর।
এম আর এম – ১৭১৪,Signalbd.com