বিশ্ব

সুদানে আরএসএফের ভয়াবহ ড্রোন হামলায় নিহত অন্তত ৩০

Advertisement

আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সুদানে আবারও রক্তাক্ত সহিংসতা। পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এল-ফাশারের বাস্তুচ্যুত শিবিরে র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এর ড্রোন হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত এবং অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছেন। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, এই হামলা ছিল একেবারেই পরিকল্পিত ও বর্বরোচিত— যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সামিল।

এল-ফাশারের রক্তাক্ত সকাল

শনিবার সকালে এল-ফাশারের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অবস্থিত দার আল-আরকাম বাস্তুচ্যুত শিবিরে আচমকা ড্রোন হামলা চালায় আরএসএফ। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁবুর সারি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ড্রোন হামলার সময় লোকজন আশ্রয়ের জন্য ভূগর্ভস্থ স্থানে ছুটে যায়। কিন্তু বোমার বিস্ফোরণে অনেক আশ্রয়স্থল ধসে পড়ে, এবং মরদেহ চাপা পড়ে যায় ধ্বংসস্তূপের নিচে। উদ্ধারকর্মীরা সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আরএসএফ বাহিনীর অবরোধের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ ও আন্তর্জাতিক আহ্বান

এল-ফাশার প্রতিরোধ কমিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই হামলা শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, এটি একটি গণহত্যা।” তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অবিলম্বে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW)অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরএসএফ বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ তুলে ধরেছে। তাদের মতে, এল-ফাশারসহ দারফুর অঞ্চলে আরএসএফ ধারাবাহিকভাবে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যা জাতিসংঘ সনদের গুরুতর লঙ্ঘন।

আরএসএফ বনাম সেনাবাহিনী: দেড় বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত

সুদানের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, যখন সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই পক্ষই দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, আর তাতে মধ্যবর্তী জনগণ পরিণত হয়েছে যুদ্ধের বলি

জাতিসংঘের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে ১০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আরও প্রায় আড়াই কোটি মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন— যা আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি।

এল-ফাশার: যুদ্ধের নতুন কেন্দ্রবিন্দু

দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশার বর্তমানে একটি কৌশলগত শহর। এটি হচ্ছে দারফুরের একমাত্র প্রাদেশিক রাজধানী যা এখনও পুরোপুরি আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে যায়নি। ফলে শহরটি এখন সেনাবাহিনী ও আরএসএফ উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী আবদুল্লাহ হামিদ বলেন,

“এল-ফাশার এখন এক মৃত নগরী। রাস্তা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়—সব ধ্বংস হয়ে গেছে। বেঁচে থাকা লোকেরা পানি ও খাবারের অভাবে দিন কাটাচ্ছে।”

আরএসএফ বাহিনী শহরের প্রবেশপথগুলো অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফলে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, শহরে বর্তমানে ৪ লাখের বেশি মানুষ অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

মানবিক পরিস্থিতি: ক্ষুধা, রোগ ও আশ্রয় সংকট

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) জানিয়েছে, এল-ফাশারের অধিকাংশ বাসিন্দা এখন চরম অপুষ্টিতে ভুগছেন। বাজারে কোনো খাদ্যদ্রব্য নেই, থাকলেও তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

এক বস্তা পশুখাদ্যের দাম এখন কয়েকশ মার্কিন ডলার, যা আগে ছিল মাত্র ২০-৩০ ডলার। মানুষ বাধ্য হয়ে পশুখাদ্য ও শুকনো পাতার ঝোল খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।

স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি জানিয়েছে, খাবারের সংকটের কারণে শহরের প্রায় সব সুপ কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে গরিব ও বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো চরম দুর্দশায় রয়েছে।

শিশু ও নারী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে

শিশুদের মধ্যে দ্রুত ছড়াচ্ছে কলেরা, টাইফয়েড ও শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ। পানি বিশুদ্ধ করার কোনো উপায় নেই, হাসপাতালে ওষুধ নেই। নারীরা চিকিৎসা বা নিরাপত্তার অভাবে আরও অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করেছে যে, যদি অবিলম্বে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো না যায়, তবে আগামী মাসগুলিতে হাজার হাজার শিশু মৃত্যুর মুখে পড়বে।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও নীরবতা

জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত সংঘাত নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতা, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, এই সংকটকে আরও জটিল করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লীগ কয়েক দফা শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিলেও, এখনো স্থায়ী সমাধানের কোনো দিক দেখা যায়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,

“সুদান এখন এক ‘অব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু’। যদি যুদ্ধ চলতেই থাকে, তাহলে এই সংঘাত শুধু সুদানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো আফ্রিকা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।”

আরএসএফ: গঠনের ইতিহাস ও অভিযোগ

র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF) গঠিত হয় ২০০৩ সালে দারফুর সংঘাত চলাকালে, মূলত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে রূপান্তরিত হয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাহিনী হয়ে ওঠে অত্যন্ত শক্তিশালী, এবং দেশটির প্রাক্তন স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়।

বহু বছর ধরে আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তবুও তারা সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, যা বর্তমান সংঘাতের মূল কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আন্তর্জাতিক চাপ ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ

বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আরএসএফ ও সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা প্রস্তুত করছে। তবে বাস্তবে বিচার প্রক্রিয়া এখনো অনেক দূরে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সুদানে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কিন্তু সীমান্তপথে এখনও অস্ত্র প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়, তবে সুদান আরেকটি সিরিয়া বা ইয়েমেনে পরিণত হতে পারে।

সুদানের এল-ফাশারে যে ট্র্যাজেডি ঘটেছে, তা কেবল একটি দেশের নয়—এটি মানবতার বিপর্যয়। প্রতিটি বিস্ফোরণ, প্রতিটি মৃত্যুই বিশ্ব বিবেককে প্রশ্ন করে: কেন আমরা এখনো নীরব?

সুদানের জনগণ এখন শুধু খাবার বা নিরাপত্তা নয়—চাইছে বাঁচার অধিকার, শান্তির নিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া।

MAH – 13272 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button