বিশ্ব

 গাজা শান্তি চুক্তির এখনও যে অস্পষ্টতা রয়েছে

Advertisement

গাজায় টানা কয়েক মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে ইসরাইল ও হামাস এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মিশরে টানা তিন দিনের আলোচনার পর বৃহস্পতিবার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনাকে “শান্তির প্রথম ধাপ” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে একাধিক প্রশ্ন থেকে গেছে, বিশেষ করে গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসন ও হামাসের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে। ফলে, গাজা শান্তি প্রক্রিয়ায় এখনও বেশ কিছু বড় অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির মূল দিকগুলো

চুক্তি অনুযায়ী, উভয় পক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এছাড়া, মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য মিশর সীমান্ত দিয়ে গাজায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০ দফা প্রস্তাবের মধ্যে এই দুটি ধারা বাস্তবায়নের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে।

তবে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় — বিশেষ করে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও গাজার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো — এখনো আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে। মার্কিন প্রশাসনের দাবি, “পরবর্তী ধাপেই এসব বিষয়ের সমাধান আসবে।” কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এগুলোই গাজা সংকটের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ।

গাজার শাসনব্যবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা

চুক্তিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে গাজার প্রশাসনিক দায়িত্ব একটি “অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট কমিটি” পরিচালনা করবে। তবে এই কমিটি কারা গঠন করবে এবং কতদিন দায়িত্বে থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।

মার্কিন প্রস্তাব অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে গাজা অঞ্চলটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এর বিরোধিতা করছেন। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, “আমরা হামাসের পরবর্তী সরকারেও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রভাব দেখতে চাই না।”

অন্যদিকে, হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা “ফিলিস্তিনি জাতীয় অধিকার থেকে একচুলও পিছবে না।” গোষ্ঠীটির মতে, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো প্রশাসনিক পরিবর্তন টেকসই হবে না।

হামাসের অস্ত্র ত্যাগের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া

শান্তি পরিকল্পনার অন্যতম মূল অংশ ছিল হামাসের নিরস্ত্রীকরণ। কিন্তু বর্তমান চুক্তিতে সেই বিষয়টি পুরোপুরি বাদ পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, “এটি পরবর্তী ধাপে আলোচনার জন্য রাখা হয়েছে।”

তবে হামাসের অবস্থান স্পষ্ট—তারা বলছে, “স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা অস্ত্র ছাড়ব না।” গোষ্ঠীটি এটিকে তাদের প্রতিরোধের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে।

এই অবস্থায় ইসরাইলের নিরাপত্তা উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা দেখতে চাই হামাস কেবল মুখে নয়, কার্যতও যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে কি না।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ

চুক্তির ঘোষণার পর জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং আরব লীগের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে প্রায় সব পক্ষই বলছে, “এটি কেবল শুরু, চূড়ান্ত শান্তির পথে আরও দীর্ঘ পথ বাকি।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা ও হামাসের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না হলে এই যুদ্ধবিরতি খুব বেশি স্থায়ী হবে না। লন্ডনভিত্তিক বিশ্লেষক লুসি ম্যানিং বলেন, “গাজার শান্তি চুক্তির এই ধাপ মূলত প্রতীকী। বাস্তবিক সমাধানের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার।”

কায়রোর মধ্যস্থতাকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা নভেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলোচনা আয়োজনের চেষ্টা করবেন, যেখানে হামাসের অস্ত্রনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাশা ও হতাশা

গাজার সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় উল্লাস প্রকাশ করেছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকা অনেক পরিবার এখন অন্তত কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। তবে অনেকের মনে রয়েছে গভীর শঙ্কা—এই শান্তি কতদিন টিকবে?

গাজা শহরের বাসিন্দা সামির হানুন বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু আগেও অনেকবার এমন ঘোষণা এসেছে। শেষে দেখেছি আবার বোমা পড়ে।”

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের পর গাজায় দ্রুত পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে হবে। বর্তমানে সেখানে ৮০ শতাংশ মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজা শান্তি প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখতে হলে তিনটি মৌলিক বিষয় পরিষ্কার করতে হবে —
১. গাজার প্রশাসন কার হাতে থাকবে,
২. হামাসের অস্ত্রনীতি কীভাবে নির্ধারিত হবে,
৩. স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা কী হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী রহমান বলেন, “শান্তি চুক্তি তখনই অর্থবহ হয়, যখন উভয় পক্ষের জন্য ন্যায্য কাঠামো নিশ্চিত করা যায়। এখন পর্যন্ত সেই কাঠামো দৃশ্যমান নয়।”

তিনি আরও বলেন, “এই চুক্তি হয়তো আপাতত যুদ্ধ থামাবে, কিন্তু প্রকৃত শান্তি আনবে কি না, তা সময়ই বলবে।”

গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি। তবে হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা, গাজার প্রশাসনিক কাঠামো, ও স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে অস্পষ্টতা রয়েছে, তা ভবিষ্যতের শান্তি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে।

আন্তর্জাতিক মহল এখন অপেক্ষা করছে—চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে কীভাবে এসব অনিষ্পন্ন বিষয় সমাধান করা হয়। প্রশ্ন রয়ে গেছে, এই চুক্তি কি সত্যিই স্থায়ী শান্তির পথ খুলে দেবে, নাকি এটি কেবল আরেকটি অস্থায়ী বিরতি মাত্র?

এম আর এম – ১৭০১,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button