বিশ্ব

জর্ডানের শরণার্থীশিবিরে বড় হওয়া ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানীর নোবেল জয়

Advertisement

বিজ্ঞান মানুষের জীবন পরিবর্তনের অন্যতম শক্তি। আর সেই বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হলো নোবেল পুরস্কার। এ বছর রসায়নে নোবেল জয় করেছেন এমন এক বিজ্ঞানী, যার জীবনকথা অনেকটা সিনেমার মতো। তিনি হলেন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ওমর এম ইয়াঘি। জর্ডানের একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন, কঠিন বাস্তবতার ভেতর থেকেও কিভাবে জ্ঞান, অধ্যবসায় এবং গবেষণা মানুষকে পৃথিবীর শীর্ষ সাফল্যে পৌঁছে দিতে পারে।

ওমর এম ইয়াঘির শৈশব: শরণার্থী শিবিরের ঘিঞ্জি ঘর থেকে শুরু

ওমর ইয়াঘির জন্ম জর্ডানের রাজধানী আম্মানের এক ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। ছোট্ট একটি কক্ষে পরিবারের সঙ্গে গবাদিপশু নিয়েই জীবন শুরু হয়েছিল তার। একবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন—

“আমি খুব সাধারণ একটি ঘরে বড় হয়েছি। ছোট্ট একটি কক্ষে আমরা অনেকজন থাকতাম। গবাদিপশুগুলোও আমাদের সঙ্গে একই ঘরে থাকত। আমার মা–বাবা খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু স্বপ্ন ছিল বড়।”

এই পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা কোনোভাবেই সহজ ছিল না। যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার ভেতর থেকেও ইয়াঘি প্রমাণ করেছেন, মেধা ও কঠোর পরিশ্রম কখনো ব্যর্থ হয় না।

পড়াশোনার পথে: যুক্তরাষ্ট্রে নতুন যাত্রা

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ওমর এম ইয়াঘি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই শুরু হয় তার গবেষণার ভিন্নতর যাত্রা। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।

নোবেল জয়: মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কের (MOF) আবিষ্কার

২০২৫ সালের নোবেল কমিটি ঘোষণা দেয়—রসায়নে এ বছরের নোবেল বিজয়ী ওমর এম ইয়াঘি, জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন

তাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার হলো মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক (Metal-Organic Frameworks বা MOF)। এটি এক ধরনের আণবিক কাঠামো, যার ভেতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে। এই কাঠামো এতটাই কার্যকরী যে এটি হাইড্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা পানি ধরে রাখতে পারে।

MOF-এর গুরুত্ব

  • পরিবেশ দূষণ রোধে কার্বন ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করা সম্ভব।
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্ষেত্রে (যেমন হাইড্রোজেন ফুয়েল) ব্যাপক ব্যবহার।
  • খরা–কবলিত অঞ্চলে বাতাস থেকে পানি সংগ্রহের প্রযুক্তি তৈরি।
  • চিকিৎসা বিজ্ঞানে ঔষধ বহনের সম্ভাবনা।

এই আবিষ্কারকে একুশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অবদান বলা হচ্ছে।

নোবেল জয়ের প্রতিক্রিয়া

নোবেল প্রাইজ আউটরিচের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অ্যাডাম স্মিথকে সাক্ষাৎকারে ইয়াঘি বলেন—

“নোবেল জেতার খবর শুনে আমি বিস্মিত, আনন্দিত ও অভিভূত। এটা শুধু আমার নয়, বিশ্বের সব শরণার্থী শিশুদের জন্য এক অনুপ্রেরণা।”

জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ (দ্বিতীয়) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন—

“জর্ডানের বিজ্ঞানী অধ্যাপক ওমর ইয়াঘি ২০২৫ সালে রসায়নে নোবেল জয় করায় আমরা গর্বিত। তার এ অর্জন জর্ডানের জন্য এক বিশাল সম্মান।”

ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মোহাম্মদ শেহাদ এক্স-এ লিখেছেন—

“এই বিজ্ঞানী ভয়াবহ পরিবেশে বড় হয়েছেন। আজকের দিনে যখন গাজায় শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হচ্ছে, তখন ইয়াঘির এই জয় ফিলিস্তিনের জন্য আশার আলো।”

শরণার্থী থেকে নোবেলজয়ী: একটি অনুপ্রেরণার গল্প

ওমর ইয়াঘির গল্প শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি শরণার্থী জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধবিধ্বস্ত, শিক্ষাহীন পরিবেশ থেকেও কিভাবে এক শিশু বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীতে পরিণত হতে পারে, তারই প্রমাণ ইয়াঘি। তিনি মনে করেন—

“বিজ্ঞান এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ আছে। যদি আপনার কৌতূহল থাকে, পরিশ্রম করার মন থাকে, তবে বিজ্ঞান আপনাকে বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি দিতে পারে।”

নোবেল পুরস্কার ও আরব বিশ্ব

নোবেল পুরস্কারের ১২৪ বছরের ইতিহাসে আরব বা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। ওমর ইয়াঘি সম্ভবত জর্ডানে জন্ম নেওয়া প্রথম নোবেল বিজয়ী।

আরব বিশ্বের জন্য এই অর্জন একটি নতুন অধ্যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সাফল্য মধ্যপ্রাচ্যের তরুণদের বিজ্ঞান ও গবেষণায় আরও বেশি আগ্রহী করে তুলবে।

ভবিষ্যৎ গবেষণা ও দৃষ্টি

ওমর ইয়াঘি বর্তমানে কাজ করছেন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি তৈরির ওপর। বিশেষ করে—

  • মরুভূমিতে পানি সংগ্রহের ডিভাইস,
  • পরিবেশ থেকে ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ প্রযুক্তি,
  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

তার স্বপ্ন হলো—পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেন পানির স্বল্পতা ও দূষণ সমস্যার সমাধান পায়।

ওমর এম ইয়াঘির নোবেল জয় একটি যুগান্তকারী ঘটনা। শরণার্থী জীবন থেকে শুরু করে বিজ্ঞান গবেষণার শীর্ষে পৌঁছানো—এ যেন ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। তার জীবনকথা আজ লাখো তরুণের জন্য অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে সেইসব শিশুদের জন্য যারা দারিদ্র্য, যুদ্ধ কিংবা শরণার্থী জীবনের ভেতর দিয়ে বড় হচ্ছে।

ওমর ইয়াঘি দেখিয়ে দিয়েছেন— “স্বপ্ন যত বড়ই হোক না কেন, পরিশ্রম আর জ্ঞানই পারে তাকে বাস্তব করতে।”

MAH – 13251 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button