
চলতি বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন বিজ্ঞানী—জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওমর এম ইয়াগি। মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক (MOF) উদ্ভাবনের জন্য তাদের এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
রসায়নে নোবেল পুরস্কার ২০২৫ ঘোষণা করেছে রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স। এ বছর যৌথভাবে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন বিজ্ঞানী—সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াগি। মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক বা MOF নামের একটি বিশেষ আণবিক কাঠামো আবিষ্কারের মাধ্যমে রসায়ন গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করায় তাদের এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
নোবেল কমিটির ঘোষণা ও কারণ
রয়েল সুইডিশ একাডেমি বুধবার (৮ অক্টোবর) স্থানীয় সময় বিকেলে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করে। এক বিবৃতিতে কমিটি জানায়, এই তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক এমন এক কাঠামো, যার ভেতরে বিশাল ফাঁকা স্থান থাকে। এই কাঠামোর ভেতর দিয়ে বিভিন্ন গ্যাস বা রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে এবং সেগুলোকে সংরক্ষণ বা পৃথক করা যায়।
নোবেল কমিটি জানায়, “তাদের কাজ রসায়নের জগতে এক নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, শক্তি সংরক্ষণ এবং পরিষ্কার জ্বালানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক কী
মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক বা সংক্ষেপে MOF হচ্ছে এমন একটি ক্রিস্টাল কাঠামো, যা ধাতব আয়ন এবং জৈব অণুর মাধ্যমে গঠিত। এর ভেতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বা ফাঁকা স্থান থাকে। এই শূন্যস্থানগুলোতে গ্যাস বা তরল পদার্থ আটকে রাখা, পৃথক করা কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ, বিষাক্ত গ্যাস ফিল্টার করা, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ, এমনকি ওষুধ সংরক্ষণ বা পরিবেশ দূষণ রোধের মতো কাজে বিশাল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান MOF কাঠামো ব্যবহার করে নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
তিন বিজ্ঞানীর জীবনী ও অবদান
সুসুমু কিতাগাওয়া জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৫১ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী ১৯৭৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কের প্রাথমিক কাঠামো উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেন।
রিচার্ড রবসন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের গ্লাসবার্নে ১৯৩৭ সালে জন্ম নেওয়া রবসন ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি MOF কাঠামোর গঠন ও স্থায়িত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
ওমর এম ইয়াগি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৬৫ সালে জর্ডানের আম্মানে জন্ম নেওয়া ইয়াগি ১৯৯০ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি MOF-এর আধুনিক প্রয়োগ নিয়ে গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বিশেষ করে বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ ও কার্বন ক্যাপচারে তার অবদান প্রশংসিত।
রসায়নে নোবেলের ইতিহাস
রসায়নে প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯০১ সালে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ১১৬ বার এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। রসায়ন নোবেল সাধারণত এমন গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয় যা মানবকল্যাণে মৌলিক প্রভাব ফেলে।
২০১৮ সালে জন বি. গুডএনাফ রসায়নে নোবেল পান, তিনি তখন ৯৭ বছর বয়সী ছিলেন—এটাই ছিল রসায়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল পাওয়ার রেকর্ড। ২০২৫ সালে এই ধারাবাহিকতায় তিন বিজ্ঞানী যৌথভাবে এই মর্যাদা অর্জন করলেন।
গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক প্রযুক্তি ভবিষ্যতের বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি গ্যাস সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, মরুভূমির বাতাস থেকে পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। একইভাবে, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও MOF ব্যবহৃত হতে পারে ওষুধ পরিবহনের ক্ষেত্রে, যেখানে নির্দিষ্ট কোষে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।
পুরস্কারের মূল্য ও আনুষ্ঠানিকতা
এই তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি দশ লাখ সুইডিশ ক্রোনার সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। ডিসেম্বর মাসে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিতব্য এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।
নোবেল কমিটি জানিয়েছে, “এই তিনজন বিজ্ঞানী আধুনিক রসায়নের ভবিষ্যৎ রূপদাতা। তাদের আবিষ্কার প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।”
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক হচ্ছে আধুনিক রসায়নের এক ‘গেম চেঞ্জার’ প্রযুক্তি। এটি শুধু রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি পরিবর্তন করছে না, বরং জ্বালানি সংরক্ষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে নতুন পথ খুলে দিচ্ছে।
জাপানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “কিতাগাওয়া ও তার সহযোগীদের কাজ আধুনিক রসায়নে নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকবে না, শিল্পক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।”
মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্কের আবিষ্কার আধুনিক রসায়নের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা, গ্যাস সংরক্ষণ ও পরিষ্কার জ্বালানি উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানীর এই অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষণায় নতুন অনুপ্রেরণা যোগাবে, এমনটাই আশা করছেন বিজ্ঞানমহল।
এম আর এম – ১৬৮০,Signalbd.com