
বাংলাদেশের খ্যাতনামা আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলমকে আটক করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তিনি ছিলেন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে গাজা অভিমুখী কনশেনস জাহাজের যাত্রী। বুধবার (৮ অক্টোবর) সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম নিজেই জানিয়েছেন যে, সমুদ্রে যাত্রাকালে তাকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) জোর করে তুলে নিয়ে গেছে।
ভিডিও বার্তায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেন—
“আমি শহিদুল আলম, বাংলাদেশের একজন আলোকচিত্রী ও লেখক। যদি এই ভিডিওটি আপনারা দেখে থাকেন, তবে বুঝবেন যে আমাদের জাহাজকে সমুদ্রে আটক করা হয়েছে। আমাকে ইসরায়েলের দখলদার সেনারা অপহরণ করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সক্রিয় সহযোগিতায় গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।”
তিনি আরও যুক্ত করেন,
“আমি আমার সহযোদ্ধা ও বন্ধুদের আহ্বান জানাচ্ছি—ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লড়াই থেমে থাকা যাবে না। এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”
ফ্রিডম ফ্লোটিলা: গাজা অবরোধ ভাঙার প্রচেষ্টা
শহিদুল আলম যে জাহাজে ছিলেন, সেটি ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের অংশ। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েল কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে আরোপিত গাজা অবরোধ ভাঙা এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকা কার্যত ইসরায়েলের অবরোধে রয়েছে। স্থল, আকাশ ও জলপথে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে গাজাবাসীরা চরম সংকটে পড়েছেন।
এই অবরোধ ভাঙতেই বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ ফ্রিডম ফ্লোটিলার সঙ্গে যুক্ত হন। শহিদুল আলমও তাঁদের একজন।
শহিদুল আলম: কণ্ঠস্বরহীনদের কণ্ঠ
শহিদুল আলম শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত নাম। তিনি শাহিদুল আলম – আলোকচিত্রী, লেখক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
- তিনি ড্রিক পিকচার লাইব্রেরি ও পাঠশালা মিডিয়া ইনস্টিটিউট-এর প্রতিষ্ঠাতা।
- ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোয় তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল।
- তিনি সর্বদা নির্যাতিত ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে কথা বলেন।
এবার গাজার উদ্দেশ্যে যাত্রা তাঁর মানবিক ও রাজনৈতিক অবস্থানেরই ধারাবাহিকতা।
আটক অভিযান: কী ঘটেছে?
ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশ করে জাহাজটিকে থামায় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনাকে শহিদুল আলম “অপহরণ” বলে আখ্যা দেন।
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো দেশের সেনা বাহিনীর এ ধরনের অভিযান বিতর্কিত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি সরাসরি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
শহিদুল আলমের আটক ও ফ্রিডম ফ্লোটিলা থামানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দা জানানো হচ্ছে।
- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলেছে, ইসরায়েল গাজার সত্য প্রকাশ পেতে দিচ্ছে না, তাই সাংবাদিক ও মানবিক কর্মীদের আটক করছে।
- জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শহিদুল আলমসহ আটককৃতদের মুক্তি দাবি করেছে।
- বিশ্বের বিভিন্ন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী, লেখক ও শিক্ষাবিদ সামাজিক মাধ্যমে #FreeShahidulAlam হ্যাশট্যাগে প্রচারণা শুরু করেছেন।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
ঢাকা থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং কূটনৈতিক চ্যানেলে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিক্রিয়া এসেছে। অনেকেই বলেছেন, একজন বাংলাদেশি নাগরিককে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে ধরে নেওয়া গুরুতর ঘটনা। তাঁরা সরকারের দৃঢ় অবস্থান দাবি করেছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু: দীর্ঘদিনের সংঘাত
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্ব কয়েক দশকের পুরোনো। ফিলিস্তিনিরা দাবি করে—তাদের ভূমি দখল করে সেখানে অবৈধভাবে ইসরায়েলি বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর এই সংঘাতের মূল কেন্দ্র।
২০২৩ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে “যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটেই ফ্রিডম ফ্লোটিলা উদ্যোগকে অনেকে মানবিক প্রতিরোধের অংশ হিসেবে দেখেন।
কেন শহিদুল আলমের আটক আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ?
১. তিনি শুধু একজন বাংলাদেশি নাগরিক নন, বিশ্বজোড়া প্রভাবশালী আলোকচিত্রী।
২. আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে তাঁকে আটক করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
৩. ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে দমন করার প্রমাণ এটি।
৪. গ্লোবাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের নাম আলোচনায় এসেছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ
গাজার জনগণ অবরোধের কারণে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। ফ্রিডম ফ্লোটিলার মতো উদ্যোগগুলো তাদের জন্য আশার আলো।
শহিদুল আলম ও তাঁর সহযাত্রীদের আটক করার মানে দাঁড়াচ্ছে—গাজাবাসীর কাছে পৌঁছানো মানবিক সহায়তা আবারও বন্ধ হয়ে গেল।
শহিদুল আলমের বার্তা: সংগ্রাম থামবে না
নিজের ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম বন্ধু ও সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন—
“ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এটি কেবল ফিলিস্তিনের নয়, সারা বিশ্বের ন্যায়বিচারের সংগ্রাম।”
শহিদুল আলমের আটক শুধু একজন আলোকচিত্রীর গল্প নয়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মানবিকতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের এক জটিল সমীকরণ।
গাজার অবরোধ ও সেখানে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে একজন বাংলাদেশি আলোকচিত্রীকে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে ধরে নেওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—শহিদুল আলম ও তাঁর সহযাত্রীদের মুক্তি দেওয়া হবে কি না।
MAH – 13219 I Signalbd.com