
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আজ সোমবার সকালে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের দিকে এক আইনজীবী জুতা ছুড়ে মারেন। ঘটনাটি ঘটে সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে, আদালতের কোর্ট নং–১-এ শুনানি চলাকালীন সময়ে। অভিযুক্ত আইনজীবীর নাম রাকেশ কিশোর, বয়স ৭১ বছর।
ঘটনার পরপরই আদালতকক্ষে উপস্থিত নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে আটক করেন এবং সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে তাঁকে দিল্লি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতির প্রতিক্রিয়া: ধৈর্য ও স্থিরতা
ঘটনায় প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাই একেবারেই বিচলিত হননি। তিনি বিচারপ্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের তিনি শান্ত থাকার আহ্বান জানান।
প্রধান বিচারপতি গাভাই দিল্লি পুলিশের দেওয়া ‘জেড প্লাস’ নিরাপত্তা সুবিধাপ্রাপ্ত। এ ধরনের ঘটনা সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল।
কেন ঘটল এই আক্রমণ?
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, রাকেশ কিশোর নামের ওই আইনজীবী মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দির চত্বরের একটি মামলার রায়ের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন।
মামলার পটভূমি
মামলাটি ছিল খাজুরাহো মন্দির চত্বরে জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকা প্রাচীন ‘ভগবান বিষ্ণু’র একটি মূর্তি পুনর্নির্মাণের আবেদন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি গাভাই দুই বিচারপতির বেঞ্চে এই মামলা শুনানি করে আবেদনটি খারিজ করে দেন।
তখন তিনি বলেন:
“এটি পুরোপুরি প্রচারের স্বার্থে দায়ের করা মামলা। আপনি যদি সত্যিই ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত হন, তবে প্রার্থনা করুন, ধ্যান করুন। দেবতা নিজেই সবকিছু করতে সক্ষম।”
এই মন্তব্যকেই অবমাননাকর বলে মনে করেছিলেন আইনজীবী রাকেশ কিশোর। তাঁর মতে, এই মন্তব্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে।
পুলিশের তদন্ত
দিল্লি পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আটক আইনজীবী ময়ূর বিহার এলাকার বাসিন্দা এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত সদস্য।
পুলিশ এখন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে সমন্বয় করছে। প্রাথমিকভাবে তাকে আটক করা হলেও, তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
ভারতের বিচারপতিদের নিরাপত্তা
ভারতের প্রধান বিচারপতিদের নিরাপত্তা সবসময়ই কঠোর থাকে। প্রধান বিচারপতি গাভাই বর্তমানে ‘জেড প্লাস ক্যাটাগরি সিকিউরিটি’ পান, যা ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তবুও সুপ্রিম কোর্টের মতো নিরাপদ স্থানে একজন আইনজীবীর এমন আচরণ আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর ভারতের আইনি মহল, রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
- আইনজীবী মহল: অনেকেই বলছেন, ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা মতভিন্নতা থাকলেও আদালতকক্ষে এমন আচরণ আইন পেশার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে।
- সামাজিক প্রতিক্রিয়া: কেউ কেউ আবার মনে করছেন, এটি কেবল হতাশার বহিঃপ্রকাশ, তবে তা সঠিক পথ নয়।
- রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: কিছু দল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে ভারসাম্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন।
প্রধান বিচারপতি গাভাই কে?
- পূর্ণ নাম: বিজয়ী রামচন্দ্র গাভাই
- দায়িত্ব গ্রহণ: ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ভারতের প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হন।
- জন্ম: ২৪ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে মহারাষ্ট্রে।
- পেশাগত জীবন: দীর্ঘদিন বোম্বে হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালতে দায়িত্ব পালনের পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিযুক্ত হন।
- বৈশিষ্ট্য: ধর্মীয় নিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন রক্ষায় কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত।
সুপ্রিম কোর্টে এর আগের বিতর্কিত ঘটনা
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এর আগেও নানা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের সাক্ষী হয়েছে, তবে আদালত কক্ষে বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করার ঘটনা অত্যন্ত বিরল।
ইতিপূর্বে রাজনীতিবিদদের ওপর জনসমাবেশে বা সংবাদ সম্মেলনে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলেও, বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে এমন ঘটনা ঘটায় তা নজিরবিহীন।
ধর্মীয় অনুভূতি বনাম আইনের ব্যাখ্যা
ঘটনাটি আবারও সামনে এনেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: ধর্মীয় অনুভূতি ও আইনের ব্যাখ্যা—এদের মধ্যে ভারসাম্য কোথায়?
প্রধান বিচারপতি গাভাই স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“আমি সব ধর্মকে সম্মান করি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর দায়িত্ব হলো ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করা। আমার মন্তব্য ধর্মের অবমাননা নয়, বরং আইনি কাঠামোর বাস্তবতা।”
তবে ধর্মীয় সংবেদনশীল বিষয় হওয়ায় অনেকেই তা ভিন্নভাবে গ্রহণ করেছেন।
বিশ্লেষণ: ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
এই ঘটনা ভারতের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১. আদালতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।
২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় আবেগের দ্বন্দ্ব সামনে এসেছে।
৩. আইনজীবীদের মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলার অভাব নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির দিকে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা নিঃসন্দেহে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। যদিও বিচারপতি গাভাই ধৈর্য ও স্থিরতা দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, তবে এ ঘটনার পর আদালতের নিরাপত্তা, বিচার বিভাগের মর্যাদা এবং ধর্মীয় অনুভূতির ভারসাম্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে সবাইকে।
এই ঘটনা শুধু ভারতের বিচার ব্যবস্থাই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং সামাজিক সহনশীলতার জন্য একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে
MAH – 13193 I Signalbd.com