
গ্রেটা থুনবার্গসহ ৭০ জন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রিসে পাঠিয়েছে ইসরাইল। এরা সবাই গ্লোবাল ফ্লোটিলা নামের এক নৌবহরের অংশ ছিলেন, যেটি গাজার উদ্দেশে সাহায্যসামগ্রী বহন করছিল। ইসরাইলি সেনারা আন্তর্জাতিক জলসীমায় প্রবেশের পর নৌবহরটি আটক করে এবং তাতে থাকা শত শত অধিকারকর্মীকে হেফাজতে নেয়। আজ সোমবার তাদের মধ্যে সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনের তরুণী আইকন গ্রেটা থুনবার্গসহ ৭০ জনকে গ্রিসে পাঠানো হয়েছে।
গাজায় পৌঁছানোর আগেই অভিযান
ফিলিস্তিনি উপত্যকা গাজায় দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইলের কঠোর অবরোধ চলছে। খাদ্য, ওষুধ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখানে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মানবিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা ‘গ্লোবাল ফ্লোটিলা’ নামে একটি নৌবহর গঠন করেন। এতে প্রায় ৪৭০ জন অধিকারকর্মী অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু বুধবার (২ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরাইলি নৌবাহিনী ফ্লোটিলাটিকে ঘিরে ফেলে এবং জোর করে আটক করে।
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই নৌবহর হামাসকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গাজায় সাহায্য পাঠাতে চেয়েছিল। তবে ফ্লোটিলায় থাকা অধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
৭০ জনকে গ্রিসে পাঠানো হলো
আজ সোমবার যাদেরকে গ্রিসে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন:
- ২৮ জন ফরাসি নাগরিক
- ২৭ জন গ্রীক নাগরিক
- ১৫ জন ইতালীয়
- ৯ জন সুইডিশ নাগরিক
এছাড়া রবিবার আলাদা আরেক দফায় ২১ জন স্প্যানিশ অধিকারকর্মী নিজ দেশে ফিরে গেছেন। তাদেরকেও গত সপ্তাহে আটক করা হয়েছিল।
গ্রেটা থুনবার্গের উপস্থিতি কেন আলোচনায়?
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে গ্রেটা থুনবার্গ সুপরিচিত। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার। এবার তিনি ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগে যোগ দেওয়ায় বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় এসেছে।
থুনবার্গ এর আগে বহুবার ফিলিস্তিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করেছেন। গত বছর তিনি স্টকহোমে ফিলিস্তিনের পক্ষে এক বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিলেন। ফলে গাজা ফ্লোটিলায় তার অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলের এই পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
- ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন ইতোমধ্যে তাদের নাগরিকদের আটক করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
- গ্রিস জানিয়েছে, তাদের নাগরিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।
- জাতিসংঘ গাজার অবরোধ এবং মানবিক সহায়তা আটকে দেওয়াকে আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী বলে উল্লেখ করেছে।
গাজার অবরোধ: এক দশকেরও বেশি সময়
২০০৭ সাল থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গাজা উপত্যকাকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে গাজার যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। ফলে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি একটি খোলা কারাগারে বসবাস করছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক মানবাধিকার সংস্থা।
খাদ্য, ওষুধ, নির্মাণসামগ্রী, এমনকি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও ঢুকতে দেওয়া হয় না। এর আগে ২০১০ সালে তুরস্ক থেকে গাজায় রওনা দেওয়া ‘মাভি মারমারা’ নামের ফ্লোটিলায় ইসরাইলি হামলায় ১০ জন কর্মী নিহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনার পর থেকেই প্রতিবার ফ্লোটিলা পাঠানো আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
এবার কেন এত বড় ফ্লোটিলা?
গ্লোবাল ফ্লোটিলায় প্রায় ৪৭০ জন অধিকারকর্মী অংশ নেওয়ার কারণ হলো, গাজার সাম্প্রতিক মানবিক বিপর্যয়। ইসরাইলের টানা হামলা, বিদ্যুৎ ঘাটতি, পানির সংকট ও ওষুধের অভাবে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি অমানবিক পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা একত্র হয়ে নৌবহরের মাধ্যমে জরুরি ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ নেন।
ইসরাইলের অবস্থান
ইসরাইল বরাবরের মতোই দাবি করছে, গাজায় যেকোনো সাহায্য সরাসরি তাদের অনুমতি ছাড়া পাঠানো যাবে না। কারণ, এগুলো ব্যবহার করে হামাস অস্ত্র তৈরি করতে পারে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি আসলে রাজনৈতিক কৌশল—গাজায় চাপ বজায় রেখে ফিলিস্তিনিদের দুর্বল করা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, গাজার অবরোধ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের শামিল। তারা বলেছে, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো একটি মৌলিক অধিকার, সেটিকে সামরিক শক্তি দিয়ে আটকানো অমানবিক।
গ্রিসে পাঠানোর পর কী হবে?
ইসরাইল জানিয়েছে, গ্রিসে পৌঁছানোর পর প্রত্যেক অধিকারকর্মী নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। তবে তাদের অনেকেই বলেছেন, সুযোগ পেলে আবারও গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব
এই ঘটনাটি শুধু মানবিক সংকট নয়, বরং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। ইউরোপের নাগরিকরা যখন ইসরাইলি অবরোধ ভেঙে গাজায় সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করছেন, তখন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সরকারের অবস্থান তুলনামূলক নীরব। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রকাশ্যে ইসরাইলের সমর্থনে থাকায় জাতিসংঘও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও বিভক্তি রয়েছে। কেউ সরাসরি ফিলিস্তিনকে সহায়তা করতে এগোচ্ছে না। এই সুযোগেই ইসরাইল তাদের দমননীতি জারি রেখেছে।
গ্রেটা থুনবার্গসহ ৭০ জন অধিকারকর্মীকে গ্রিসে পাঠানো নিছক একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বৃহৎ আন্তর্জাতিক ইস্যু। এটি শুধু মানবিক সাহায্য আটকানো নয়, বরং ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও পরিষ্কার হলো—গাজার অবরোধ আর শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইস্যু নয়, এটি বিশ্বমানবতার ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
MAH – 13180 I Signalbd.com