
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের টানা বিমান হামলায় নতুন করে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৭০ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধও রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় শুধু গাজা সিটি থেকেই অন্তত ৪৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস বলছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি ও যুদ্ধবিরতির আহ্বান থাকলেও বাস্তবে ইসরায়েল তাদের আগ্রাসন থামাচ্ছে না। বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা কমানোর ইসরায়েলি সরকারের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিদিনের রক্তক্ষয়ী ঘটনাগুলোতে।
অব্যাহত আগ্রাসন: প্রতিদিনই নতুন শোক
গাজার গণমাধ্যম কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত শনিবারই ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অন্তত ৯৩ বার বিমান হামলা চালায়। বিভিন্ন আবাসিক ভবন, বাজার, স্কুল ও শরণার্থী শিবিরে আঘাত হানে এসব হামলা। ফলে একদিনেই প্রাণ হারান ৭০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি।
গাজার দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, অনেক পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একাধিক আবাসিক ভবনে পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে। নিহতদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু বলে জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ট্রাম্পের সরব ভূমিকা
হামলার ভয়াবহতা দেখে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়েছেন অবিলম্বে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে। তিনি বলেন, হামাস তার প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে বন্দি মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে, তাই আর আক্রমণের যৌক্তিকতা নেই।
ট্রাম্পের ভাষায়—“আমি বিশ্বাস করি হামাস দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য প্রস্তুত। সুতরাং ইসরায়েলকেও এখনই আগ্রাসন থামাতে হবে।”
মিসরের মধ্যস্থতা
শনিবার মিসর ঘোষণা করেছে, আগামী সোমবার কায়রোতে ইসরায়েলি ও হামাস প্রতিনিধিরা বসবেন আলোচনায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময় এবং মানবিক সহায়তার প্রসার নিয়ে কথা হবে।
এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প তার ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। পরিকল্পনায় উল্লেখ রয়েছে—
- ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা
- হামাসের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু
- ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি
- গাজায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করা
- দীর্ঘমেয়াদে দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে কূটনৈতিক উদ্যোগ
মানবিক সংকট চরমে
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় এখন চরম মানবিক বিপর্যয় চলছে। লাখো মানুষ খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকটে ভুগছে। টানা বিমান হামলার কারণে হাসপাতালগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে চিকিৎসকরা অপারেশন থিয়েটার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
শিশুদের পুষ্টিহীনতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনেক পরিবার একবেলা খাবার পাচ্ছে না। গাজার শরণার্থী শিবিরে এক মা বলেন, “আমরা জানি না আগামীকাল বাঁচব নাকি মরব। আমাদের শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদছে, কিন্তু ঘরে খাবার নেই।”
আরব ও ইসলামি দেশগুলোর প্রতি আহ্বান
হামাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আরব ও ইসলামি দেশগুলোর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, তারা যেন ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়। শুধু বিবৃতি নয়, বরং বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি—যাতে অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ হয় এবং ত্রাণ প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।
ইসরায়েলের অবস্থান
অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হামাসের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত অভিযান থামাবে না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, “আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা দরকার আমরা করব।”
তবে সমালোচকরা বলছেন, ইসরায়েল আসলে বেসামরিক জনগণকে টার্গেট করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনাকে “যুদ্ধাপরাধ” আখ্যা দিচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। লন্ডন, প্যারিস, ইস্তাম্বুল, কায়রো, নিউইয়র্কসহ নানা শহরে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, অবিলম্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করা উচিত।
দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রশ্ন
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী সমাধান সম্ভব কেবল দুই রাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং শক্তিশালী দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতির কারণে সমাধান অধরাই থেকে যাচ্ছে।
গাজায় প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। নারী-শিশুর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ শান্তির আহ্বান জানালেও মাটিতে বোমার বিস্ফোরণ থামছে না। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—কবে থামবে এই রক্তপাত? মানবতার স্বার্থে কি এবার সত্যিই কার্যকর উদ্যোগ নেবে বিশ্ব?
MAH – 13158 I Signalbd.com