মধ্যপ্রাচ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে। গাজায় মানবিক সহায়তা নিয়ে যাওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ত্রাণবাহী নৌবহরে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ও আটকের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এর মধ্যেই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো’ সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম কড়া বার্তা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— “ইসরায়েলকে এখনই থামাতে হবে।”
আনোয়ার ইব্রাহিমের মতে, ফিলিস্তিনি জনগণের উপর যে অমানবিক দমননীতি চলছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। শুধু তাই নয়, গাজামুখী ত্রাণবাহী জাহাজ আটকে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও জেনেভা কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আটক মালয়েশিয়ান নাগরিক
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম জানিয়েছেন, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌবহরে থাকা ২৩ জন মালয়েশিয়ান নাগরিককে ইসরায়েলি বাহিনী আটক করেছে। এদের মধ্যে চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক রয়েছেন। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
এক ভিডিও বার্তায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন:
“আমি মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের—তুরস্ক, মিশর ও কাতারের সহায়তা চাইব। আমাদের নাগরিকদের মুক্তি নিশ্চিত করতে এবং ফিলিস্তিনের মানুষের পাশে দাঁড়াতে মালয়েশিয়া নীরব থাকবে না।”
তিনি আরও যোগ করেন, মানবিক সহায়তার নামে কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা হয়নি। অথচ ইসরায়েলি বাহিনী জাহাজে উঠে নির্বিচারে হামলা ও আটক কার্যক্রম চালিয়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা কী?
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক মানবিক উদ্যোগ। এর মূল লক্ষ্য—গাজায় দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ মানুষের কাছে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী ও জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
- ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের অবরোধের শিকার।
- জাতিসংঘের তথ্যমতে, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মানবিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে।
- গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সেই সংকট লাঘবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণ সংগ্রহ করে পাঠিয়ে আসছে।
কিন্তু প্রায়শই ইসরায়েলি নৌবাহিনী এসব জাহাজকে আটকে দেয়, কখনও হামলা চালায়। ২০১০ সালে “মাভি মারমারা” নামের ফ্লোটিলায় হামলায় ১০ জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। তখন বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
তুরস্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান অত্যন্ত জরুরি।
মিশর
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি কায়রোতে এক বিবৃতিতে জানান, মানবিক ত্রাণ জাহাজে হামলা অগ্রহণযোগ্য। মিশর আন্তর্জাতিক সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
কাতার
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বলেছেন, গাজা উপত্যকার মানুষ আজ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। তিনি মালয়েশিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
কেন গাজায় মানবিক সহায়তা জরুরি?
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক দপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
- গাজার ৮০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
- খাদ্য ঘাটতির কারণে প্রতিদিন হাজারো শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
- হাসপাতালগুলোতে ওষুধ সংকট চরম পর্যায়ে।
- বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি মানুষকে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো বারবার মানবিক সহায়তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েলি অবরোধের কারণে তা প্রায়ই ব্যাহত হয়।
মালয়েশিয়ার অবস্থান
মালয়েশিয়া বহু বছর ধরেই ফিলিস্তিনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আসছে। আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে।
তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন:
- মালয়েশিয়া ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি সমর্থন করে।
- জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষপাতী।
- জাতিসংঘ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC) এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।
মানবিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবিক সহায়তা বহনকারী জাহাজে হামলা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ও জেনেভা কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানায়, গাজার মানুষের কাছে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানো আটকানো মানে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের কষ্ট বাড়ানো। এটি Collective Punishment বা সমষ্টিগত শাস্তি, যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ।
ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হামাস উভয়ই মালয়েশিয়ার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। গাজার স্থানীয় প্রশাসনের মুখপাত্র বলেন:
“আমরা মালয়েশিয়ার জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা সবসময় আমাদের পাশে থেকেছে। আজ যখন আমাদের সন্তানরা ক্ষুধায় কাঁদছে, তখন ত্রাণবাহী জাহাজ আটকে দেওয়া অমানবিক।”
পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি নীরব সমর্থন দিচ্ছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কেউ “সহনশীলতা”র আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু কড়া নিন্দা বা চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ দেখা যায়নি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন:
“যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানো জরুরি, সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা যদি সত্যিই মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে, তবে আজই তাদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।”
মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত কেবল ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আজ বৈশ্বিক মানবিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। গাজা উপত্যকার মানুষের দুর্দশা লাঘব না হলে বিশ্ব শান্তি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের কড়া বার্তা বিশ্বনেতাদের চোখ খুলে দিতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে একটি সত্য স্পষ্ট—মানবিক সহায়তার নামে জাহাজ আটকে দেওয়া কখনোই সভ্য বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
MAH – 13136 I Signalbd.com



