
রাশিয়া সম্প্রতি ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছে—ভারতের মাটিতেই তৈরি করা যেতে পারে পঞ্চম প্রজন্মের সুখোই সু-৫৭ (Su-57) যুদ্ধবিমান। মস্কো ইতিমধ্যে নয়াদিল্লিকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা কেবল বিমান সরবরাহ করেই থামতে চায় না, বরং ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যৌথভাবে এই অত্যাধুনিক ফাইটার জেটের স্থানীয় উৎপাদন শুরু করতে আগ্রহী।
এই প্রস্তাব ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। কেননা ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সহযোগিতায় মিগ সিরিজ এবং সুখোই সু-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করেছে। এবার সু-৫৭ নিয়ে এমন উদ্যোগ ভারতকে প্রযুক্তি, শক্তি এবং কৌশলগত দিক থেকে আরও এগিয়ে দেবে।
রাশিয়ার প্রস্তাব ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, সম্প্রতি ভারত রাশিয়ার কাছে দুই স্কোয়াড্রন (প্রায় ৩৮টি বিমান) সু-৫৭ কেনার আগ্রহ জানিয়েছে। এর জবাবে মস্কো জানায়, তারা খুশিমনে এই প্রস্তাব গ্রহণ করছে এবং যথাসময়ে বিমান সরবরাহ করবে। একই সঙ্গে রাশিয়া চেয়েছে, এই বিমানগুলো যেন ভারতেই উৎপাদন করা হয়।
ভারত সরকার এখন এই প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি সবকিছু অনুকূলে থাকে তবে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL)-এর নাসিক কারখানায় এই উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
কেন নাসিক?
HAL-এর নাসিক ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের একটি বড় ভরসা। এখানেই তৈরি হয়েছে মিগ-২১, মিগ-২৯ এবং সবচেয়ে সফল সু-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নাসিক কারখানা সু-৫৭-এর মতো আধুনিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে সু-৫৭ অনেক বেশি জটিল এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে স্টেলথ প্রযুক্তি, কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল, উন্নত রাডার এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থা। ফলে নাসিক কারখানাকে আধুনিকীকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রয়োজন হবে।
সু-৫৭ যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য
সুখোই সু-৫৭ একটি পঞ্চম প্রজন্মের মাল্টি-রোল যুদ্ধবিমান। এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—
- স্টেলথ ক্ষমতা: রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে শত্রুর ঘাঁটিতে আঘাত হানতে সক্ষম।
- সুপার ম্যানুভারেবিলিটি: আকাশে অতিরিক্ত গতিশীলতা ও দ্রুত মোড় ঘোরার ক্ষমতা।
- দূরপাল্লার আক্রমণ: শত্রুর প্রতিরক্ষা ভেদ করে দীর্ঘ দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম।
- আধুনিক সেন্সর: ৩৬০ ডিগ্রি কভারেজের রাডার ও উন্নত ইলেক্ট্রনিক ওয়্যারফেয়ার সিস্টেম।
- যে কোনো আবহাওয়ায় যুদ্ধক্ষমতা: দিন-রাত, বৃষ্টি-ঝড় নির্বিশেষে মিশন সম্পাদন করতে পারে।
এই সব কারণে সু-৫৭ বিশ্বের অন্যতম আলোচিত যুদ্ধবিমান।
ভারতের কৌশলগত প্রেক্ষাপট
ভারত বর্তমানে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা। আকাশ প্রতিরক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ফাঁক পূরণ করাই এখন ভারতের প্রধান লক্ষ্য।
যদিও ভারত নিজস্ব AMCA (Advanced Medium Combat Aircraft) প্রকল্পে কাজ করছে, তবে সেটি পুরোপুরি কার্যকর হতে এখনও সময় লাগবে। সেই ফাঁকে বিদেশি প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে সু-৫৭, ভারতের চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
রাশিয়া-ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ইতিহাস
ভারত ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বহু পুরনো। মিগ সিরিজ থেকে শুরু করে ব্রহ্মোস মিসাইল—সব জায়গায়ই মস্কো ভারতের প্রধান অংশীদার। বর্তমানে ভারতের বিমানবাহিনীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম রাশিয়া-নির্ভর।
- মিগ-২১: ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষার প্রথম ভরসা।
- মিগ-২৯: একসময়কার আধুনিক যুদ্ধবিমান।
- সুখোই সু-৩০ এমকেআই: বর্তমানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড।
- ব্রহ্মোস মিসাইল: যৌথভাবে তৈরি বিশ্বের দ্রুততম সুপারসনিক মিসাইল।
এই প্রেক্ষাপটে সু-৫৭ প্রস্তাব আসা মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। বরং এটি সম্পর্ককে আরও গভীর করবে।
অর্থনীতি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর
প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া কতটুকু প্রযুক্তি ভারতকে হস্তান্তর করবে?
- ইঞ্জিন: সু-৫৭-এর ইঞ্জিন অত্যাধুনিক, যা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।
- স্টেলথ কোটিং: রাডার এড়ানোর জন্য বিশেষ আবরণ দরকার, যা এখনো রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
- অ্যাভিয়নিক্স: সেন্সর ও রাডার সিস্টেম সরাসরি প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।
এই চুক্তি হলে ভারতে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প আরও শক্তিশালী হবে। তবে প্রযুক্তি স্থানান্তরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও সরবরাহ সমস্যাও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সম্ভাব্য সময়রেখা
- প্রাথমিক ধাপ: ২০২৬-২০২৭ সালের মধ্যে প্রথম ব্যাচের সু-৫৭ ভারত পেতে পারে।
- স্থানীয় উৎপাদন: সম্পূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তরের পর নাসিকে উৎপাদন শুরু হতে পারে ২০২৮-২০২৯ সালের দিকে।
- পূর্ণ কার্যকারিতা: বাস্তবিক উৎপাদন ও সরবরাহ পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হতে ২০৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
কূটনৈতিক প্রভাব
ভারতের জন্য এই সিদ্ধান্ত কেবল সামরিক দিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ—
- আমেরিকা: তারা চাইবে ভারত F-35 বা অন্য পশ্চিমা বিকল্প বেছে নিক।
- চীন-পাকিস্তান: ভারত যদি সু-৫৭ পায়, তবে এটি অঞ্চলের ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনবে।
- রাশিয়া: ভারতকে অংশীদার বানিয়ে নিজেদের প্রযুক্তি ও বাজার টিকিয়ে রাখতে চায়।
ভারতের জন্য সু-৫৭ একটি বড় সুযোগ, তবে সঙ্গে ঝুঁকিও কম নয়।
মূল প্রশ্নগুলো হলো—
- রাশিয়া কতটুকু প্রযুক্তি ভারতকে দেবে?
- স্থানীয় উৎপাদন কত দ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে?
- এর ফলে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান কেমন হবে?
যদি সবকিছু অনুকূলে থাকে, তবে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।
MAH – 12996 I Signalbd.com