বিশ্ব

পারমাণবিক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল ইরান

Advertisement

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) টেলিভিশন ভাষণে স্পষ্ট করেছেন, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। তিনি এই ধরনের আলোচনাকে দেশের জন্য কোনোভাবেই উপকারী মনে করেন না এবং সতর্ক করে বলেন, এটি দেশের নিরাপত্তার জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।

খামেনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকারের সঙ্গে আলোচনা আমাদের জন্য কোন ফলপ্রসূ উপায় নয়। বরং এটি দেশের নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে। মার্কিন হুমকিগুলোকে যদি আমরা স্বীকার করি, তবে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশিত হবে। আমেরিকা সবক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে এবং সামরিক আগ্রাসনের হুমকি দেয়। সুযোগ পেলে তারা আরও মানুষ হত্যা করবে এবং পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।”

খামেনির এই মন্তব্য আসে এমন এক সময়ে যখন ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে চলেছে। তেহরান বরাবরই দাবি করে আসছে যে, তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ এবং দেশের শক্তি ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, তেহরানকে বারবার পারমাণবিক চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে।

২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তির আওতায় ইরান পারমাণবিক সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ এবং প্লুটোনিয়াম উৎপাদনে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে বাধ্য ছিল। কিন্তু পশ্চিমা মহল অভিযোগ করে, ইরান চুক্তির অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে। যদিও ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যান, তেহরান বরাবরই তাদের কর্মকাণ্ডকে শান্তিপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করেছে।

পারমাণবিক কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক দীর্ঘদিনের বিতর্কের বিষয়। পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইরানকে সতর্ক করেছে যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতার সময়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উল্লেখ করেছিলেন, “ইরান কখনও পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না। বিশ্বে সন্ত্রাসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তারা বিবেচিত।” ট্রাম্পের এই মন্তব্য ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করেছে।

অপরদিকে, তেহরান পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে বলেছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা এবং শিল্পের উন্নয়নের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। তারা দাবি করেছে যে, ইউরেনিয়ামের সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধকরণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে হচ্ছে এবং কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক বা সামরিক উদ্দেশ্য নেই।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক: ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই উত্তপ্ত। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক টানাপোড়েনপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

  • পারমাণবিক চুক্তি (২০১৫): ইরান আন্তর্জাতিক শক্তি দেশগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির অধীনে ইরান পারমাণবিক সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সীমিত পরিমাণে সংরক্ষণ ও উৎপাদনের শর্তে বাধ্য ছিল।
  • চুক্তি থেকে মার্কিন প্রত্যাহার (২০১৮): ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বের হয়ে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক চাপ বাড়ায়।
  • আর্থিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে ইরানের তেল, ব্যাংকিং এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এই সমস্ত ঘটনাক্রম তেহরান ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। খামেনির সাম্প্রতিক বক্তব্যও এই দীর্ঘমেয়াদী উত্তেজনার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?

বিশ্বের বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় না বসার সিদ্ধান্ত একদিকে দেশটির স্বাধীনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এটি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও বাড়াতে পারে।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, তেহরান এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে, তারা কোনো আঘাত বা হুমকিতে ভয় পাবে না এবং নিজেদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের পথে অবিচল।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র কূটনৈতিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

  1. বিদ্যুৎ উৎপাদন: পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করতে সাহায্য করছে।
  2. চিকিৎসা ও শিল্প: পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যান্সার চিকিৎসা, শিল্প উৎপাদন ও গবেষণার কাজ করা হচ্ছে।
  3. বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি: পারমাণবিক গবেষণার মাধ্যমে দেশটি বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে সহায়ক প্রযুক্তি ও দক্ষতা অর্জন করছে।

ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট

খামেনির মন্তব্য পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো হয়তো আরও চাপ সৃষ্টি করবে, কিন্তু তেহরান তাদের নীতি এবং পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।

বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক পারমাণবিক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল ইরানএবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। সম্ভাব্য কূটনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, তবে সরাসরি আলোচনার অভাবে উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। খামেনির সরাসরি আলোচনার প্রত্যাখ্যান ইরানের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত করছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো এই সিদ্ধান্তকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।

ইরান তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং নিজেদের দেশের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে প্রধান্য দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন বিতর্ক ও কূটনৈতিক চাপে রূপান্তরিত হতে পারে।

MAH – 12990 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button