আঞ্চলিক

টেকনাফে মানব পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে নারী-শিশুসহ ৮০ জন উদ্ধার

Advertisement

কক্সবাজার জেলার সীমান্তঘেঁষা টেকনাফ দীর্ঘদিন ধরেই মানব পাচার, অপহরণ ও মাদক ব্যবসার জন্য কুখ্যাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। ঠিক এই অঞ্চলেই আবারও উন্মোচিত হলো মানব পাচারকারী চক্রের আরেকটি আস্তানা। যৌথ বাহিনীর অভিযানে নারী-শিশুসহ অন্তত ৮০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।

রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিজিবি-২ ব্যাটালিয়ন ও র‍্যাবের সমন্বিত অভিযানে গহীন পাহাড়ি এলাকায় এ সফলতা আসে।

অভিযানের সূচনা

টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (বিজিবি-২) এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জানান—গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, টেকনাফের রাজারছড়া পাহাড়ি এলাকায় মানব পাচারকারীরা নতুন করে আস্তানা গেড়েছে। সেখানে অপহৃত মানুষদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় এবং সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল।

সংবাদ পাওয়ার পর বিজিবি ও র‍্যাবের যৌথ দল এলাকায় অভিযান চালায়। তবে চক্রটি অভিযানের খবর টের পেয়ে পাহাড়ের উঁচু অংশ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে গুলি ও পাথর নিক্ষেপ করে। কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর যৌথবাহিনী আস্তানাটি ঘিরে ফেলে এবং ভেতরে অভিযান চালায়।

নারী-শিশুসহ ৮০ জনের উদ্ধার

অভিযান শেষে পাহাড়ি আস্তানা থেকে অন্তত ৮০ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা হলেও, বেশিরভাগই অপহরণের শিকার। অনেকে আবার সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় দালালদের প্রলোভনে পড়েছিলেন, যাদেরকে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে জড়ো করা হয়েছিল।

অস্ত্র ও পাচারকারী আটক

অভিযানে চারজন পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়—

  • দুটি দেশীয় তৈরি একনলা বন্দুক
  • একটি বিদেশি পিস্তল
  • তিন রাউন্ড গুলি

এ ছাড়া পাচারের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামও উদ্ধার করেছে যৌথবাহিনী।

পাচারের কৌশল

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই চক্রটি মূলত তিন ধাপে পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করত—
১. প্রলোভন দেখানো: দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা মধ্যপ্রাচ্যে ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টার্গেট করা।
২. অপহরণ ও আটক: ভুক্তভোগীদের পাহাড়ি আস্তানায় আটকে রেখে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা।
৩. সাগরপথে পাচার: সুযোগ পেলে ট্রলারযোগে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠানো।

কেন টেকনাফ?

টেকনাফ ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা। একদিকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল, অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্ত—এই ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়েই মানব পাচারকারীরা এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এছাড়া কক্সবাজারে আশ্রিত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতিও এই অপরাধচক্রের জন্য বড় সহায়ক। অনেক রোহিঙ্গা তরুণ পাচারের টোপে পড়ে কিংবা পাচারচক্রে যোগ দিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

মানব পাচার রোধে সরকারের উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে মানব পাচার প্রতিরোধে একাধিক আইন ও পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়ন করা হয়, যা এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখে।

তবে আইন প্রয়োগকারীদের মতে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনবল ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্বেগ

জাতিসংঘ, আইওএম (International Organization for Migration) ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার জানিয়েছে যে, কক্সবাজার ও টেকনাফ বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানব পাচার হটস্পট। প্রতিবছর শত শত মানুষ সাগরপথে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, যাদের অনেকেই আর জীবিত ফিরে আসে না।

২০২৩ সালে আইওএম-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কেবল ২০২২ সালেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে অন্তত ৩৫০ জন বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নিখোঁজ হয়েছিলেন পাচারের সময়।

ভুক্তভোগীদের করুণ কাহিনি

উদ্ধার হওয়া এক নারী জানান, তাঁকে স্বামী ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। পরে তিনি সন্তানসহ পাহাড়ে আটকা পড়েন। আরেক তরুণ বলেন, তাঁকে কুয়ালালামপুরে কারখানার চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তাকে টেকনাফ পাহাড়ে বন্দি করে রাখা হয়।

এসব অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, মানব পাচারকারীরা প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে ফাঁদে ফেলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিশ্রুতি

লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন—

“টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার, অপহরণ ও মুক্তিপণ ব্যবসা অনেক দিন ধরেই চলছে। আমরা এসব চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি এবং কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানব পাচার রোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন—

  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি
  • বেকারত্ব দূরীকরণ
  • রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কঠোর নজরদারি
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

তারা বলছেন, পাচারচক্র আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। তাই এ অপরাধ দমনে কেবল বাংলাদেশ নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

টেকনাফে মানব পাচার চক্রের আস্তানা থেকে নারী-শিশুসহ ৮০ জনের উদ্ধার নিঃসন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় সাফল্য। তবে এই ঘটনাই আবারও প্রমাণ করে, সীমান্তঘেঁষা এই জনপদ এখনো পাচারকারীদের দখলে নিরাপদ নয়।

অভিযানে উদ্ধার হওয়া মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সামাজিক ও মানসিক সহায়তা জরুরি। একইসঙ্গে মানব পাচারকারীদের দমন ও বিচারের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

MAH – 12938 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button