
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে অবস্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশেই গতকাল বুধবার ভয়াবহ পদদলনের ঘটনা ঘটেছে। এই দুঃখজনক ঘটনায় অন্তত ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই পদদলিত হয়ে এবং শ্বাসরোধে প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের কারণে ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং এরপরই এই প্রাণঘাতী পদদলনের ঘটনা ঘটে।
বিস্তারিত ঘটনাক্রম ও মৃতের সংখ্যা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বুধবার সকালে খান ইউনিসে জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে বড় এক ভিড় জমে। ক্ষুধার্ত ও দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা অসহায় মানুষজন খাদ্য ও সহায়তা নিতে একসঙ্গে জমায়েত হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রে প্রবেশের জন্য প্রধান গেট বন্ধ থাকায় ভিড় নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা হয়।
এই পরিস্থিতিতে গেটের বাইরে মার্কিন সেনারা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। হুড়োহুড়ি এবং দৌড়ঝাঁপ শুরু হলে অনেক মানুষ পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানা গেছে, নিহত ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন শ্বাসরোধ এবং পদদলনের কারণে মারা গেছেন। বাকিরা আহত অবস্থায় মারা যান।
জিএইচএফ’র অভিযোগ ও সরকারি প্রতিবাদ
ঘটনার পর কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিএইচএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ভিড়ের চাপে ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং ‘চরম বিশৃঙ্খলা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে’ একজনকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।
জিএইচএফ দাবি করে, হামাস সংশ্লিষ্ট কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি ওই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী। তারা আরও বলেছে, তাদের একজন মার্কিন ঠিকাদারকে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং ভিড়ে একাধিক অস্ত্র দেখা গেছে।
তবে এই অভিযোগ মেনে নেয়নি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা বলেছে, জিএইচএফের এই বয়ান ভিত্তিহীন এবং ভুল। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সশস্ত্র উসকানিদাতারা এই ভিড়ের ভীতিকর পদদলনের জন্য দায়ী নয়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, “আমরাও সবাই সাধারণ মানুষ, খাবারের জন্য দৌড়াচ্ছিলাম। গেট বন্ধ দেখে হাজার হাজার মানুষ চাপা পড়েছিল। তখন মার্কিন সেনারা কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে ভিড় ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এর পরই হুড়োহুড়ি শুরু হয়।”
গতকালকের ঘটনা গাজার মানুষের জন্য নতুন এক ট্রাজেডি
গাজার নাসের হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, “ক্ষুধার্ত ও হতাশ মানুষজন খাদ্য সহায়তা নিতে এসেছিল, কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় তারা প্রবেশ করতে পারেনি। এরপর নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি চালায়, যা আরও হতাহতের কারণ হয়েছে।”
জিএইচএফ গত মে মাসের শেষ থেকে গাজায় কাজ শুরু করার পর থেকে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী অন্তত ৮৭৫ জন খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৭৪ জনই মারা গেছেন জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের আশপাশে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি সম্প্রতি বলেন, অধিকাংশ নিহতই গুলিতে মারা গেছে। গাজায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সহিংসতার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
গাজার মানবিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের ডাক
গাজায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘাত এবং ইসরায়েলি অবরোধের কারণে মানুষ জীবিকার তীব্র সংকটে পড়েছে। খাদ্য ও চিকিৎসাসহ মৌলিক প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি সংঘাত দ্রুত বন্ধ করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
সংবাদ সারাংশ:
- গাজার খান ইউনিসে জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের বাইরে পদদলনের ঘটনায় ২১ জন নিহত।
- নিহতদের অধিকাংশই পদদলিত ও শ্বাসরোধে মারা গেছে।
- মার্কিন সেনারা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করায় হুড়োহুড়ি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
- জিএইচএফ ‘হামাস সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র উসকানিদাতা’দের দায়ী করার অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে খারিজ।
- গত মে মাস থেকে গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত ৮৭৫ জন নিহত হয়েছেন।
- জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গাজায় সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
কীভাবে গাজার মানবিক সংকট মোকাবেলা করা যায়?
গাজার সংকট দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল। নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষা ছাড়া এই সংকট সমাধান কঠিন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই:
- অবিলম্বে গাজায় অবরোধ তুলে দিতে হবে।
- নিরাপদ ও সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।
- শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত আলোচনার আয়োজন করতে হবে।
- গাজায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধি করতে হবে।