গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক হামলার কারণে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা এক বিধ্বংসী পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। নারী, শিশু এবং বয়স্কসহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, শতাধিক বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। এই বিপর্যয়ে সাধারণ প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না?
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার বর্তমান সংকটের মধ্যে জাতিসংঘের অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বের মূল কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও মহাশক্তিধর দেশগুলোর প্রভাব।
জাতিসংঘ ও শান্তিরক্ষী মিশন
১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে মিসরের সুয়েজ খাল আক্রমণ করেছিল। জাতিসংঘের দ্রুত পদক্ষেপ সেই সংকটকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
সেই অভিজ্ঞতা দেখায়, যদি সদস্যরাষ্ট্রগুলো রাজনীতিক সদিচ্ছা দেখায়, জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে বর্তমান গাজার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে বড় দেশগুলোর সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থী নীতি জাতিসংঘকে কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ও রাজনৈতিক বাধা
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের কার্যক্রম নিয়ে অন্তত ছয়বার ভেটো দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গাজার উপর যুদ্ধবিরতি বা মানবিক সাহায্যের পথ নিশ্চিত করতে কোনো প্রস্তাব পাশ করতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদে মহাশক্তি দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে সীমিত করেছে। ফলে গাজার ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
সাধারণ পরিষদ ও কার্যকর পদক্ষেপের সুযোগ
যদিও নিরাপত্তা পরিষদে বাধা আছে, সাধারণ পরিষদ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। ১৯৫৬ সালের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, সাধারণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম।
কিন্তু বর্তমানে সাধারণ পরিষদ বিভক্ত। বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সমন্বিত অবস্থান নেই। ফলে কার্যকর প্রস্তাব জমা পড়েনি এবং কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়নি।
জাতিগত নিধন ও অতীত উদাহরণ
গাজার পরিস্থিতি আধুনিক ইতিহাসের অন্যান্য জাতিগত নিধনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। রুয়ান্ডা, বসনিয়া, দারফুর ও লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘ প্রায়শই সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডায় জাতিগত হত্যাযজ্ঞের সময় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন সতর্কতা জানিয়েছিল, তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। গাজার বর্তমান নৃশংসতা সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
গাজার ধ্বংসযজ্ঞে জাতিসংঘের অক্ষমতার অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র জোগান এবং রাজনৈতিক সমর্থন দেয়। ফলে জাতিসংঘের নিজস্ব পদক্ষেপ সীমিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো কার্যকর বাহিনী নেই। এটি এককভাবে গাজায় জাতিগত নিধন বা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়। মহাশক্তিধর দেশগুলো ছাড়া কার্যকর হস্তক্ষেপ অসম্ভব।
বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতামত
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মার্টিন শ এবং ক্যাটো ইনস্টিটিউটের ডাগ ব্যান্ডো মত দিচ্ছেন, গাজার সংকটে জাতিসংঘের অক্ষমতার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক স্বার্থ এবং বৃহৎ দেশগুলোর হস্তক্ষেপ।
গাজা পরিস্থিতি এ ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার সীমাবদ্ধতা এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আন্তরিকতার অভাব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
গাজায় চলমান মানবিক সংকট দেখায়, জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম নয়। রাজনৈতিক স্বার্থ, মহাশক্তিধর দেশগুলোর প্রভাব এবং সাধারণ পরিষদের বিভক্তি জাতিসংঘের কার্যক্রম সীমিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একসঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে জাতিসংঘ একা এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
এম আর এম – ১৪৫২,Signalbd.com



