বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি গম আমদানির চুক্তি আজ
বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারিভাবে গম আমদানির চুক্তি আজ ২০ জুলাই রোববার স্বাক্ষরিত হবে। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আসতো দাতব্য বা সাহায্য হিসেবে, এবার প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সরাসরি গম আমদানি শুরু হচ্ছে। এই উদ্যোগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ পরিকল্পনার অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের (ইউএসডিএ) শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং বাংলাদেশের খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা এই সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করবেন। এর ফলে বাংলাদেশে আমদানিকৃত গমের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে।
বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর জন্য নতুন কৌশল
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ব্যবধান কমানো সরকারের একটি অগ্রাধিকার বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে আমদানি কমানো এবং নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি বাড়ানো এখন সরকারের মূল লক্ষ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে, যার অংশ হিসেবে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি গম আমদানি করবে প্রায় তিন লাখ টন। তবে প্রথম পর্যায়ে চুক্তি হবে ২ লাখ ২০ হাজার টনের। প্রতি কনসাইনমেন্টে এক লাখ ১০ হাজার টন করে গম আসবে। এর জন্য সরকার প্রতি টনে মার্কিন বাজারের বাজারমূল্যের থেকে ২০-২৫ ডলার বেশি মূল্য দিতে রাজি হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমরা মূলত তিনটি লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছি — দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি, জনমত গঠন (অ্যাডভোকেসি), এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানো।”
বাণিজ্যিক আলোচনার অবস্থা ও শুল্ক হ্রাসের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের ৭৬৮ কোটি ডলারের তুলনায় বেড়েছে। তবে আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমেছে, ২৫০ কোটি ডলার থেকে ২৬২ কোটি ডলারে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক মার্কিন বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় স্ক্র্যাপ লোহা বা লোহার টুকরা। এসবের পাশাপাশি গম, ভোজ্যতেল, তুলা, এলএনজি, এবং উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ আমদানিও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যের ওপর বাংলাদেশ থেকে আমদানির ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকে প্রভাবিত করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই দফা আলোচনার পরও এই শুল্ক কমাতে পারেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক হার প্রযোজ্য করার কথা ঘোষণা করেছেন, যা বর্তমান ১৫ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোট ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে।
শেখ বশিরউদ্দীন নেতৃত্বে বাংলাদেশি একটি প্রতিনিধি দল তৃতীয় দফার আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাবে। তবে, এখনো আলোচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ হয়নি। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, আজ রোববার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্ক হ্রাসের আলোচনার তারিখের জন্য অনুরোধ পাঠানো হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের গুরুত্ব
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে দুই দেশের বাণিজ্য ব্যবধান প্রায়ই সমীকরণে ওঠে, যা বাংলাদেশ কমাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু আমদানিতে শুল্ক ও বাণিজ্য বাধাগুলো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্ক শূন্য রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আরও ১০০ পণ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কোনো দেশের পণ্যের ওপর আলাদা শুল্ক কমানো সম্ভব নয়; তা পণ্যের ওপর নিরপেক্ষভাবে কমাতে হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাণিজ্য কৌশল যেন এক দেশকেন্দ্রিক না হয়, অন্য অংশীদারদের অবদান ও পরিস্থিতিও বিবেচনায় রাখা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও ডব্লিউটিওর ভূমিকা নিয়েও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।”
উচ্চমূল্যে গম আমদানির ঝুঁকি ও পরামর্শ
বর্তমান বিশ্ববাজারে ডলার সংকটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চমূল্যে গম আমদানির সিদ্ধান্ত কিছু দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে গমের চাহিদা বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশসহ কিছু পণ্যের আমদানিও বাড়ানোর কথা থাকায় খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সতর্ক করেছেন, দর-কষাকষি পর্যায়ে যতটুকু অঙ্গীকার করা দরকার, শুধু সেটুকুই করা উচিত।
তিনি বলেন, “যদি চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে তা দেশের জন্য ভবিষ্যতে ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই বাণিজ্যিক আলোচনায় খুবই সাবধান হতে হবে।”
আগামী দিনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি গম আমদানির সিদ্ধান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে গমের নিরাপদ ও পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হবে এবং আমদানি বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভরতা কমবে। পাশাপাশি, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বাড়ানোর একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তবে, বাণিজ্যিক শুল্ক, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য ওঠাপড়া, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি ও কৌশল যতটা সম্ভব বহুমুখী ও সমন্বিত হওয়া প্রয়োজন।
সারসংক্ষেপ
- বাংলাদেশ আজ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারি গম আমদানির চুক্তি করবে।
- ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা।
- যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ও নতুন শুল্ক হার নিয়ে আলোচনা চলমান।
- বাংলাদেশের রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে বাড়লেও আমদানিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
- বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে গম ছাড়াও ভোজ্যতেল, এলএনজি, উড়োজাহাজ যন্ত্রাংশ আমদানির পরিকল্পনা।
- বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ।



