বিশ্ব

ভারতে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে অবমাননা, প্রতিবাদে মামলা দায়ের ২০০ মুসলিমের বিরুদ্ধে

ভারতের উত্তরপ্রদেশে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (সা.) নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তত ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে স্থানীয় পুলিশ। বিষয়টি এখন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকি জেলায়। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণ কেশব দীক্ষিত নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেন, যেখানে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়। পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং অভিযুক্তের গ্রেফতারের দাবিতে সদর বাজার থানা ঘেরাও করেন।

অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা

প্রতিবাদকারীদের চাপের মুখে পুলিশ দ্রুত কৃষ্ণ কেশব দীক্ষিতকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫এ ও ১৫৩এ ধারা প্রয়োগ করা হয়। এই ধারাগুলো ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা, ঘৃণা ছড়ানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো অপরাধের আওতায় পড়ে।

তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ এতেই প্রশমিত হয়নি। তারা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে স্মারকলিপি জমা দেন এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন, বিশেষ করে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (NSA) অনুযায়ী মামলা করার দাবি জানান।

পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও নতুন উত্তেজনা

অভিযুক্তের গ্রেফতারের পর স্থানীয় হিন্দু গোষ্ঠীগুলো পাল্টা বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, মুসলিমরা “অতিরিক্ত চাপ” সৃষ্টি করছে এবং প্রশাসনকে “প্রভাবিত” করার চেষ্টা করছে। এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা নতুনভাবে দেখা দেয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ মুসলিম প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধেই কড়া পদক্ষেপ নেয়। স্থানীয় প্রশাসনের অভিযোগ, মুসলিমরা অনুমতি ছাড়াই রাস্তায় জড়ো হয়েছিল এবং সরকারি কাজে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এ অভিযোগে প্রায় ২০০ মুসলিমের বিরুদ্ধে একাধিক ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দণ্ডবিধির ১৯১(২), ৫৪, ৫৭, ৩২৪(৫), ১২৬ ইত্যাদি ধারা।

ভারতের মুসলিমদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ

ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে বারবার আঘাত করা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ভারতের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন বলছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে উল্টো প্রতিবাদকারীদের টার্গেট করা হচ্ছে। এতে মুসলিমরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে এবং আইনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া

ভারতের এই ঘটনাটি শুধু দেশীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ভারতের মতো একটি বহুত্ববাদী দেশে ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মুসলিমদেরই মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে—এটি উদ্বেগজনক।

এছাড়া, অনেকে মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা ভারতের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে অবমাননা করার ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য দেশব্যাপী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তখনও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয় এবং মুসলিমদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে।

এমনকি তখন আরব বিশ্বের একাধিক দেশ ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।

বর্তমান ঘটনার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব

বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করছে, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলিমরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়ানো এবং এর জেরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি এখন এক বড় হুমকি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই নির্বাচনের আগে সামনে আসে, যা একপ্রকার কৌশল হিসেবেই ব্যবহার করা হতে পারে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি

মুসলিম নেতারা বলছেন—
১. ধর্মীয় অবমাননা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
২. ঘৃণাত্মক কনটেন্ট ছড়ানো ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৩. প্রতিবাদ করলেই মামলা নয়, বরং প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. প্রশাসনের উচিত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, পক্ষপাতিত্ব নয়।

ভারতের উত্তরপ্রদেশে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননার ঘটনায় একদিকে অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেও, অন্যদিকে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে প্রশাসন। এতে মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের আরও প্রান্তিক ও অসুরক্ষিত মনে করছে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় এসেছে—ভারতে ধর্মীয় সম্প্রীতি কতটা টেকসই এবং মুসলিমরা কতটা ন্যায়বিচার পাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এ ঘটনার প্রভাব শুধু উত্তরপ্রদেশেই নয়, বরং পুরো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেই পড়তে পারে।

MAH – 12893 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button