ব্রিটেন দেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি, ট্রাম্পের আপত্তি

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাজ্য খুব শিগগিরই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফেরার পরপরই লন্ডন এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেবে। যদিও ওয়াশিংটন থেকে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি এসেছে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাজ্যের নয়, বরং গোটা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তুলতে যাচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয় এবং বিশ্বশক্তিগুলোর অবস্থান এই ইস্যুকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
কিয়ার স্টারমারের অবস্থান
২০২৪ সালে লেবার পার্টির বিশাল বিজয়ের পর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া কিয়ার স্টারমার মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান দেখিয়ে আসছেন। জুলাই মাসে তিনি প্রকাশ্যে সতর্ক করেছিলেন, যদি ইসরায়েল গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব না করে এবং প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা হামলা বন্ধে যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়, তবে লন্ডন বাধ্য হবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে।
স্টারমারের মতে, “শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হলো দুটি রাষ্ট্র সমাধান। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন—দুটো রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই স্বীকৃতি দিয়ে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে।”
ট্রাম্পের বিরোধিতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরের মতো ইসরায়েলপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়াবে। দ্য টাইমস জানিয়েছে, ট্রাম্প তাঁর সফর শেষে আজ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলে ব্রিটেন এই ঘোষণাটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, হোয়াইট হাউস এ সিদ্ধান্তে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। ওয়াশিংটন মনে করছে, এ ধরনের পদক্ষেপ ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
ইউরোপীয় দেশগুলোর ভূমিকা
শুধু ব্রিটেনই নয়, ইউরোপের একাধিক দেশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বা প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
- ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এপ্রিল ২০২৫-এ ঘোষণা করেছিলেন, কয়েক মাসের মধ্যেই প্যারিস ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।
- স্পেন, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড এ বছরের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।
- সুইডেন ২০১৪ সালেই এ পদক্ষেপ নিয়েছিল।
এই ধারাবাহিকতার মধ্যে যুক্তরাজ্যের সিদ্ধান্ত বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। কারণ, ব্রিটেন ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকটের সঙ্গে জড়িত। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা–র মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলেই।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
এখনও পর্যন্ত লন্ডনের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসরায়েলের সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলআবিব এই ঘোষণাকে ‘কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নেবে। ইসরায়েল বরাবরই দাবি করে এসেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেছে। কয়েকদিন আগেই প্রকাশিত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল গাজায় জাতিগত নিধন চালাচ্ছে। এই প্রতিবেদনের পর ইউরোপীয় দেশগুলো আরও সরব হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বহুবার বলেছেন, “দুই রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।” ব্রিটেনের আসন্ন সিদ্ধান্তকে তাই জাতিসংঘের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেক কূটনীতিক।
গাজার মানবিক সংকট
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের অব্যাহত সামরিক অভিযান ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে।
- জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
- হাসপাতালগুলোতে ওষুধের ঘাটতি প্রকট, পরিষ্কার পানি ও বিদ্যুতের সংকট তীব্র।
- শিশু ও নারীর মধ্যে মৃত্যুহার দ্রুত বেড়ে চলেছে।
এই মানবিক সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তৎপর করেছে ফিলিস্তিন ইস্যুতে।
যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক বার্তা
ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর এখনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী স্টারমার মনে করছেন—এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং মানবিক সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, লন্ডন শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রিটেনের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
- মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
- যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট হবে এবং সম্ভবত লন্ডনের সঙ্গে কিছু কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিলিস্তিন ইস্যুতে আগেই বিভক্ত ছিল। ব্রিটেনের সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির গতি আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যুক্তরাজ্যের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করবে।
ট্রাম্পের বিরোধিতা সত্ত্বেও স্টারমার সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এ পদক্ষেপ হয়তো ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে।
MAH – 12891 I Signalbd.com