বিশ্ব

ভারতে মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার সংক্রমণে ১৯ জনের মৃত্যু

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যে এক মারাত্মক সংক্রমণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (PAM) নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। কেরালা রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, এ বছরের শুরু থেকে ৬১টি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

সুস্থ শিশু থেকে শুরু করে তরুণ ও বৃদ্ধ—সব ধরনের মানুষেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি বিরল রোগ হলেও এর সংক্রমণ অত্যন্ত মারাত্মক। রাজ্যজুড়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা কী?

এই রোগের মূল কারণ হলো নেগেলারিয়া ফাওলেরি (Naegleria fowleri) নামক এক প্রকারের ‘মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা’। এটি প্রধানত উষ্ণ এবং অপরিশোধিত মিঠা জলে বাস করে। পুকুর, হ্রদ, উষ্ণ নদী বা বেসিনের অপরিশোধিত জল এই অ্যামিবার প্রকৃতির পরিবেশ হিসেবে কাজ করে।

সংক্রমণ ঘটে যখন এই জল নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে, যা সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে। এরপর এটি মস্তিষ্কের টিস্যু ধ্বংস করে এবং মারাত্মক মেনিনগোএনসেফালাইটিস সৃষ্টি করে।

ডাক্তারদের মতে, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় সবাই মারা যায়। এই রোগের প্রতিকার এখনো সীমিত, তাই এটি অত্যন্ত প্রাণঘাতী।

সংক্রমণের লক্ষণ

নেগেলারিয়া ফাওলেরি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর মধ্যে দেখা দিতে পারে:

  • জ্বর
  • তীব্র মাথা ব্যথা
  • বমি
  • ঘনিষ্ঠতার অভাব ও বিভ্রান্তি

রোগ প্রগাঢ় হলে দেখা দিতে পারে:

  • মস্তিষ্কে ফুলে যাওয়া (সোয়েলিং)
  • আচরণ পরিবর্তন
  • শ্বাসকষ্ট ও মৃত্যুর সম্ভাবনা

এই রোগের প্রতি সংক্রমণই বিপজ্জনক, কারণ সংক্রমণ পাওয়ার ৫–৭ দিনের মধ্যে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়।

কেরালায় সংক্রমণের পরিসংখ্যান

কেরালা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী:

  • ২০২৫ সালের শুরু থেকে ৬১টি সংক্রমণ ঘটেছে।
  • মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১৯।
  • মৃত্যুর হার প্রায় ৩১%।
  • আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ বা মধ্যবয়সী।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, উষ্ণ জলাশয়ে সাঁতার কাটা, গোসল করা বা জল ব্যবহারে সতর্কতা না নিলে সংক্রমণ আরও ছড়াতে পারে।

কীভাবে সংক্রমণ ছড়ায়?

নেগেলারিয়া ফাওলেরি প্রধানত:

  • উষ্ণ, স্থির এবং অপরিশোধিত মিঠা জলে বাস করে।
  • নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কে পৌঁছে সংক্রমণ ঘটায়।
  • এই সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

ডাক্তাররা উল্লেখ করেছেন, উষ্ণ জলাশয়ে সাঁতার কাটা, নাক দিয়ে জল ঢোকানো এবং অপরিষ্কৃত জল ব্যবহার বিরল না হলে মারাত্মক হতে পারে।

ভারতীয় স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং কেরালা রাজ্য সরকার জনসাধারণকে সতর্ক করেছে। প্রধান নির্দেশাবলী হলো:

  1. উষ্ণ ও স্থির জলাশয়ে সাঁতার কাটা বা গোসল করা থেকে বিরত থাকা।
  2. পুকুর, হ্রদ, নিকটস্থ খাল বা অপরিশোধিত জল ব্যবহার না করা।
  3. নাক দিয়ে জল প্রবেশ করতে না দেওয়া।
  4. জল শোধন ও উষ্ণ করা হলে ব্যবহার করা।
  5. প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পরীক্ষা করানো।

সুস্থতার প্রতি সচেতন থাকাই একমাত্র প্রতিকার।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (PAM) একটি বিস্তারিত বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন:

  • ২০১৬ সালে ভারতে প্রথমবার PAM শনাক্ত হয়।
  • তারপর থেকে sporadic (অল্প কয়েকটি) কেস ছড়িয়েছে।
  • যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানেও কিছু ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং CDC এই রোগকে দুর্লভ কিন্তু মারাত্মক বলে চিহ্নিত করেছে।

কেরালার প্রস্তুতি ও জনসচেতনতা

কেরালা সরকার ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে:

  • স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক প্রচারণা।
  • জলাশয়ে সাঁতার কাটার নিয়মাবলী কঠোর করা।
  • সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগ শনাক্তকরণ ব্যবস্থা উন্নত করা।

ডাক্তাররা বলছেন, জনসাধারণের সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রমণ রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

ডাঃ ভিনা জর্জ, কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সাংবাদিকদের বলেছেন:

“এই রোগ বিরল হলেও মারাত্মক। আমাদের লক্ষ্য হল মানুষকে সচেতন করা এবং সংক্রমণ রোধ করা। উষ্ণ জলাশয়ে নাক দিয়ে জল প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকা একমাত্র সুরক্ষা।”

অন্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, PAM-এর চিকিৎসা জটিল। আক্রান্ত রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা হলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু তা ব্যর্থ হলে মৃত্যু অনিবার্য।

নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা

নাগরিকদের প্রতি বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা:

  • উষ্ণ পুকুর, হ্রদ বা অপরিশোধিত জল ব্যবহার করবেন না।
  • গরম জল দিয়ে গোসল করলে নিরাপদ।
  • প্রাথমিক লক্ষণ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা বা বিভ্রান্তি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ।
  • শিশু ও তরুণদের বিশেষভাবে নজর রাখুন।

এছাড়া, স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে PAM-এর মতো মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

কেরালায় মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার সংক্রমণ ইতিমধ্যেই ১৯ জনের প্রাণ কেড়েছে। এটি একটি দুর্লভ কিন্তু মারাত্মক রোগ, যা দ্রুত শনাক্তকরণ ও সতর্কতা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

সরকার, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। সচেতনতা, নিরাপদ জল ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা এই রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিকার।

কেরালার উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি, প্রাকৃতিক জলাশয়ে সতর্ক না হলে মারাত্মক রোগ যে কোনো সময় ছড়াতে পারে।

MAH – 12890 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button