বিশ্ব

ভারতে মানুষকে কামড়ালে কুকুরের শাস্তি ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’

ভারতের উত্তর প্রদেশে কুকুরের কামড়ের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় রাজ্য সরকার এক চাঞ্চল্যকর ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কুকুর যদি হঠাৎ করে মানুষকে কামড়ায়, তবে তাকে প্রথমবার অপরাধে ১০ দিনের জন্য পশুকেন্দ্রে বন্দি রাখা হবে। কিন্তু একই কুকুর যদি দ্বিতীয়বার মানুষকে কামড়ায়, তাহলে তাকে সারাজীবনের জন্য বন্দি রাখা হবে — অর্থাৎ ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ দেওয়া হবে কুকুরটিকে।

এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই ভারতের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে প্রাণীপ্রেমী সংগঠন পর্যন্ত সবাই এই নতুন নিয়ম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত?

ভারতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং তারা সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু উত্তর প্রদেশেই কয়েক লাখ বেওয়ারিশ কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মানুষকে কামড়ানোর ঘটনা ঘটছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর প্রদেশে প্রতিবছর প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ কুকুরের কামড়ে আহত হন। শুধু তাই নয়, এই কামড়ের কারণে জলাতঙ্ক (Rabies) ছড়ানোর আশঙ্কাও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী বেওয়ারিশ কুকুরের কামড়।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জননিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে উত্তর প্রদেশ সরকার এই নতুন নিয়ম জারি করেছে।

নতুন নিয়মের বিস্তারিত

  • প্রথম অপরাধে শাস্তি: কোনো কুকুর যদি অযথা বা বিনা উসকানিতে কাউকে কামড়ায়, তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পশুকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে এবং ১০ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
  • মাইক্রোচিপ বসানো: ১০ দিনের পর্যবেক্ষণের শেষে কুকুরটির দেহে মাইক্রোচিপ বসানো হবে, যাতে ভবিষ্যতে সে আবার কামড়ালে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
  • দ্বিতীয় অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড: একই কুকুর যদি দ্বিতীয়বার মানুষকে কামড়ায়, তবে তাকে আর রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হবে না। সারাজীবনের জন্য পশুকেন্দ্রে বন্দি রাখা হবে।
  • দত্তক নেওয়ার সুযোগ: কোনো সহৃদয় ব্যক্তি চাইলে আদালতে হলফনামা দিয়ে সেই কুকুরকে দত্তক নিতে পারবেন, তবে শর্ত হলো কুকুরটিকে আর কোনোদিন রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যাবে না।

উত্তর প্রদেশের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. বিজয় অমৃতরাজ বলেন, “এই নিয়ম মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আনা হয়েছে। একইসাথে কুকুরগুলোকেও একটি পরিচিতি বা আইডেন্টিটি দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।”

ভারতের আদালত ও কুকুর ইস্যু

ভারতে বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে আদালতও নানা নির্দেশনা দিয়েছে। ২০২৩ সালে দিল্লিতে কুকুরের কামড়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল রাস্তা থেকে সব বেওয়ারিশ কুকুর সরাতে। তবে প্রাণীপ্রেমীদের তীব্র প্রতিবাদের কারণে সেই নির্দেশ শিথিল করা হয়।

আদালত পরবর্তীতে জানিয়েছে, প্রাণী হত্যা নয়, বরং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করাই সমাধান। কুকুরদের টিকা, নির্বীজন (Sterilization) এবং নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি।

প্রাণীপ্রেমীদের উদ্বেগ

নতুন নিয়ম ঘোষণার পর প্রাণী অধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, কুকুর কামড়ানোর পেছনে পরিবেশগত অনেক কারণ থাকে। রাস্তায় খাবারের অভাব, মানুষের হুমকি বা নির্যাতনের শিকার হলে কুকুর আগ্রাসী হয়ে ওঠে। শুধু বন্দি করলেই সমস্যার সমাধান হবে না।

একটি প্রাণী অধিকার সংগঠনের মুখপাত্র বলেন,
“মানুষের মতো প্রাণীরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। শুধু কামড়ানোর কারণে যাবজ্জীবন বন্দি করে রাখা অমানবিক। বরং নির্বীজন, টিকাদান এবং সঠিক খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করলেই এই সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।”

সাধারণ মানুষের মতামত

অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় কুকুরের কামড়ের ঘটনা প্রায়শ ঘটে, সেখানকার মানুষদের দাবি:

  • শিশুদের স্কুলে যাওয়ার পথে কুকুরের ভয় থাকে।
  • বৃদ্ধ বা অসুস্থ মানুষদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে।
  • অনেকেই ভয়ে রাতে রাস্তায় বের হতে চান না।

তাদের মতে, সরকারের এই নিয়ম জননিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

উত্তর প্রদেশে বেওয়ারিশ কুকুরের বাস্তব অবস্থা

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশে সবচেয়ে বেশি বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য বলছে:

  • লখনউ শহরে প্রায় ১.৫ লাখ বেওয়ারিশ কুকুর রাস্তায় ঘোরে।
  • গ্রামীণ এলাকাতেও অবস্থা ভয়াবহ।
  • টিকাদান কর্মসূচি সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় জলাতঙ্কের ঝুঁকি বাড়ছে।

বিশ্বব্যাপী বেওয়ারিশ কুকুর সমস্যা

ভারত একমাত্র দেশ নয় যেখানে বেওয়ারিশ কুকুর একটি বড় সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই একই সমস্যা দেখা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই দেশগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছে কুকুরের নির্বীজন ও টিকাদান বাড়াতে। উন্নত দেশগুলোতে যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলোতে রাস্তার কুকুর তেমন দেখা যায় না। সেসব দেশে প্রাণী কল্যাণ আইন কঠোর এবং আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা উন্নত।

সমাধানের পথ কী হতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার:

  • নির্বীজন কর্মসূচি জোরদার করা: এতে নতুন বাচ্চা জন্ম কমবে।
  • টিকাদান নিশ্চিত করা: জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি।
  • আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো: বেওয়ারিশ কুকুরগুলো নিরাপদে থাকতে পারবে।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষ কুকুরদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, সে সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে।

উত্তর প্রদেশ সরকারের এই নতুন নিয়ম নিঃসন্দেহে এক আলোচিত সিদ্ধান্ত। একদিকে এটি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে প্রাণী অধিকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

তবে স্পষ্ট যে, শুধু আইন করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নির্বীজন, টিকাদান, আশ্রয়কেন্দ্র ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি।

সমাজের নিরাপত্তা ও প্রাণীর কল্যাণ— এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

MAH – 12874  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button