গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ বোমাবর্ষণ: শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের নতুন অধ্যায়
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আবারও ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরাইল। মঙ্গলবার ভোর থেকে টানা বিমান হামলায় একদিনেই অন্তত ১০৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্থানীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। গাজায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিদিনের জীবন এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার সমান।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন: ‘এটি একটি গণহত্যা’
জাতিসংঘের সর্বশেষ এক তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজায় ইসরাইলি বাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তা একটি “গণহত্যা”। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই হামলায় শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। অবরুদ্ধ গাজায় খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সামগ্রীর মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই, আহতদের চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি রাষ্ট্রও ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে অমানবিক বলে নিন্দা জানিয়েছে।
আরব ও ইসলামী বিশ্বের জরুরি বৈঠক
গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে আরব ও ইসলামী বিশ্বের শীর্ষ নেতারা দোহায় একত্রিত হয়েছেন। তারা এক জরুরি বৈঠকে বসে ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেন—
“গাজায় যা ঘটছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আমরা এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ মেনে নিতে পারি না।”
তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরানসহ একাধিক দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও এখনো ইসরাইল হামলা থামায়নি।
২০২৩ থেকে বর্তমান: রক্তাক্ত হিসাব
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪ হাজার ৯৬৪ জন ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক লাখ ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই বিশাল প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে গাজায় হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, নিহতদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই শিশু। এ পর্যন্ত হাজার হাজার স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও গৃহ ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইলি সেনারা।
আন্তর্জাতিক ক্ষোভ ও নিন্দা
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও নরওয়ের রাজধানীতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরেও যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছে সাধারণ জনগণ।
এদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের করেছে। আদালতের বিচারকরা বর্তমানে এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন।
ইসরাইলের অবস্থান
ইসরাইলি সরকার দাবি করছে, তারা “হামাস দমনের” নামে এই অভিযান চালাচ্ছে। তবে বাস্তবে যে হামলা চলছে তা কেবল সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সাধারণ মানুষকেই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, ইসরাইলের এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।
গাজায় মানবিক সংকট ভয়াবহ
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ এখন বাস্তুচ্যুত। তারা স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনে অমানবিকভাবে বসবাস করছে। খাবার নেই, পানির তীব্র সংকট, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় বন্ধ। শিশু ও বয়স্কদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
একজন ফিলিস্তিনি মা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন—
“প্রতিদিন মনে হয় শেষ দিন। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি না। বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে, আবার কখন ঘুম আসবে তাও জানি না।”
যুদ্ধবিরতির দাবি
আন্তর্জাতিক মহল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি তুলছে। তবে এখনো ইসরাইল তাদের হামলা বন্ধের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। বরং তারা বলছে, “হামাস সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত” অভিযান চলবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন—
“এই যুদ্ধ অবিলম্বে থামাতে হবে। প্রতিটি প্রাণ মূল্যবান। ফিলিস্তিনি শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা হচ্ছে।”
গাজায় ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসন আজ পুরো বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। প্রতিদিন লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে, অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নিন্দা সত্ত্বেও ইসরাইল তার অবস্থান থেকে সরে আসছে না। এখন প্রশ্ন হলো— মানবতার এই ভয়াবহ বিপর্যয় থামাতে বিশ্বশক্তিগুলো কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে?
MAH – 12860 Signalbd.com