ট্রাম্পের দ্বিতীয় ব্রিটেন সফর: যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন সম্পর্কের নতুন দিগন্ত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে লন্ডনে পৌঁছেছেন। এটি তার দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর, যা মার্কিন ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। সাধারণত একজন প্রেসিডেন্ট মাত্র একবার রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রিত হন, কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে।
এ সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা—সব খাতে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা ও আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ব্রিটেনের রাজা চার্লস উইন্ডসর ক্যাসেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে স্বাগত জানাবেন। এ আয়োজন হবে ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় প্রটোকল অনুযায়ী—সামরিক অভ্যর্থনা, গান স্যালুট এবং রাজকীয় ভোজের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এই সফর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জন্য এই সফর অনেকটা রাজনৈতিক সুরক্ষার মতো। কারণ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাকে কঠিন কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার ম্যান্ডেলসনকে বরখাস্ত করা।
ওয়াশিংটন-লন্ডন ‘বিশেষ সম্পর্ক’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এ সফরকে “বিশেষ সম্পর্ক জোরদার” করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চান কিয়ার স্টারমার।
এরই অংশ হিসেবে সফরের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ও ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস যৌথভাবে “ট্রান্সআটলান্টিক টাস্কফোর্স” গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত
ট্রাম্পের সফরের অন্যতম বড় দিক হচ্ছে ব্যবসা ও বিনিয়োগ চুক্তি। এ সফরে কয়েকশ’ কোটি ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
- মাইক্রোসফট ঘোষণা করেছে, আগামী চার বছরে তারা ব্রিটেনে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে।
- গুগল জানিয়েছে, প্রায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড (৬.৮ বিলিয়ন ডলার) তারা ব্রিটেনে বিনিয়োগ করবে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হবে লন্ডনের কাছে নতুন ডেটা সেন্টার নির্মাণে।
- এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং এবং ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্যবসায়ী নেতারা এ সফরে অংশ নিচ্ছেন।
স্টারমার চান, এসব বিনিয়োগ ব্রিটেনকে প্রযুক্তি, জ্বালানি ও আর্থিক খাতে আরও শক্তিশালী করে তুলুক।
ট্রাম্পের জন্য মানসিক স্বস্তি
এই সফর ট্রাম্পের জন্যও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও রক্ষণশীল নেতা চার্লি কার্ককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ট্রাম্পের জন্য এই রাষ্ট্রীয় সফর অনেকটা স্বস্তি বয়ে এনেছে।
একই সঙ্গে তিনি চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে স্টারমারের চ্যালেঞ্জ
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জন্য এ সফর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেইনার ও রাষ্ট্রদূত ম্যান্ডেলসনকে বিদায় দিতে হয়েছে, যা তার সরকারের স্থিতিশীলতায় আঘাত হেনেছে।
এখন ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ নিশ্চিত করে তিনি জনগণের আস্থা ফেরাতে চাইছেন। স্টারমার ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন—“এই সফর একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, যা শুধু ব্রিটেন নয়, গোটা বিশ্বের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
দুই নেতার বৈঠক ও আলোচ্যসূচি
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী স্টারমার তার সরকারি রেসিডেন্স চেকার্সে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ জানাবেন। সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মূলত নিচের বিষয়গুলোতে আলোচনা হবে—
- যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও নতুন বিনিয়োগ।
- বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।
- জ্বালানি সংকট মোকাবিলা ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ।
- প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সহযোগিতা।
- ন্যাটো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক জোটে দুই দেশের ভূমিকা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের এই বিশেষ সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই ট্রাম্পের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফরকে কেবল একটি আচারিক আয়োজন নয়, বরং একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প-স্টারমার যুগলবন্দি?
যদিও ট্রাম্প একজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট এবং স্টারমার একজন লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী, তবুও দুই নেতা তাদের দেশের অর্থনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে চাইছেন। বিশ্লেষকদের মতে, “বাস্তব রাজনীতি”-ই তাদের এক করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর শুধু আড়ম্বরপূর্ণ কূটনৈতিক ইভেন্ট নয়, বরং এটি দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার একটি বাস্তব সুযোগ। এই সফরের মাধ্যমে অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ভিত্তি আরও মজবুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
MAH – 12859 Signalbd.com