বিশ্ব

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ

গাজায় চলমান সংঘাতকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এর পেছনে পরিকল্পিত উসকানি রয়েছে। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সহ দেশটির শীর্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।

জাতিসংঘের এই অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা ধ্বংস, খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে বাধা সৃষ্টি এবং জনগণকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে।

জাতিসংঘের তদন্তের মূল তথ্য

৭২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ কেবল যুদ্ধাপরাধ নয়, আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার সংজ্ঞার মধ্যেও পড়ে।

  • প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের গণহত্যায় উসকানিদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • গাজায় নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিশেষত ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলোকে টার্গেট করে ধ্বংস করা হয়েছে, যা একটি জাতিগত গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল হিসেবে ধরা হচ্ছে।
  • ত্রাণ প্রবেশে ইচ্ছাকৃত বাধা সৃষ্টি এবং লক্ষাধিক মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।

জাতিসংঘের মতে, এসব কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ক্রমাগতভাবে বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
হাসপাতাল, স্কুল, বাজার, শরণার্থী শিবির — কোনো স্থানই হামলার বাইরে থাকছে না। গাজা সিটির বড় অংশ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা ছাড়া চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। তার ভাষায়, “নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষদের এভাবে লক্ষ্য করে আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতার বিরুদ্ধে।”

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলেছে, “গাজা সিটির পরিস্থিতি দ্রুত আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এই শহরকে গণকবরে পরিণত করা হচ্ছে।”

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তবে বড় শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

দীর্ঘদিনের দমননীতি

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণ বহু বছর ধরেই অবরোধ ও হামলার মুখে রয়েছে। ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকরা একে নিরাপত্তা রক্ষার পদক্ষেপ বলে দাবি করলেও বাস্তবে এটি এক প্রকার নিয়মিত দমননীতি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজার ওপর আরোপিত অবরোধ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ফিলিস্তিনিদের ভেঙে দিয়েছে। এর সাথে সামরিক অভিযান যোগ হওয়ায় পরিস্থিতি এখন মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।

গণহত্যার প্রমাণ ও আন্তর্জাতিক আইন

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ইসরায়েলের কার্যক্রম “Genocide Convention” বা গণহত্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রতিবেদনটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এ প্রেরণ করা হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে। যদি পাঠানো হয়, তবে ইসরায়েলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ মতামত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন ভবিষ্যতের কূটনৈতিক সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা, আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীতি — সবকিছুই নতুন করে আলোচনায় আসবে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলোও গাজায় চলমান এই গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ও জাতিসংঘের নতুন প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে এক কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে: মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন রক্ষার জন্য বিশ্ব কি সত্যিই কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, নাকি রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে আবারও নীরব থাকবে?
পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে গাজার সাধারণ মানুষের মানবিক সঙ্কট আরও গভীর হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এখন সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এই গণহত্যা বন্ধ করা এবং একটি স্থায়ী শান্তির পথ তৈরি করা।

এম আর এম – ১৩৬২,Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button