জুলাইয়ে আবারও বাড়ল মূল্যস্ফীতি হার ৮.৫৫%

চার মাসের টানা নিম্নমুখী প্রবণতার পর ২০২৫ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি আবারও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা আগের মাস জুনে ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন বিশেষজ্ঞদের চিন্তিত করেছে এবং সাধারণ মানুষের জন্য নতুন করে চাপ তৈরি করেছে।
মূল্যস্ফীতি কোথায় কেমন?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
- খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭.৫৬%, যা আগের মাসের তুলনায় বেশি।
- অ-খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৮%।
উল্লেখযোগ্য যে, এই দুই খাতেই আগের মাসের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। অর্থাৎ খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।
জুনে ছিল ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন মূল্যস্ফীতি
২০২৫ সালের জুনে ৮.৪৮% মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বনিম্ন গত প্রায় তিন বছরে। বাজারে স্বস্তির কিছু ইঙ্গিত মিলছিল, বিশেষ করে পণ্য আমদানিতে শুল্ক ও কর কমানো, সুদের হার বাড়ানোসহ সরকার ঘোষিত নানা নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপের কারণে। কিন্তু সেই আশার বার্তা বেশিদিন টিকলো না। জুলাই মাসেই আবার ঊর্ধ্বমুখী চিত্রে ফিরল মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি কীভাবে প্রভাব ফেলে?
মূল্যস্ফীতি সাধারণত মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। অর্থনীতির ভাষায়, এটি ‘নীরব কর’ হিসেবে পরিচিত, কারণ এর ফলে মানুষ কোনও কর না দিয়েও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ:
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আপনি যদি ১০০ টাকায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা সেবা কিনতেন,
তাহলে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সেই একই জিনিস কিনতে আপনাকে ১০৮ টাকা ৫৫ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে।
অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় আপনার খরচ বেড়েছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা।
যদি আপনার আয় বা মজুরি একই থাকে, তবে এ অতিরিক্ত খরচ চালাতে গিয়ে আপনাকে হয় ধার করতে হবে, নয়তো খরচ কমিয়ে দিতে হবে। এতে সরাসরি জীবনের মান কমে যায়।
সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে:
- সুদের হার বৃদ্ধি করে টাকা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা।
- এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) তেল, ডিম, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক-কর হ্রাস করেছে।
- আমদানি প্রবাহ সচল রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে বাজারে সরবরাহ সংকট না হয়।
- বাংলাদেশ ব্যাংক কারণ বিশ্লেষণ করে মনিটরি পলিসি রিভাইজ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তবে এই পদক্ষেপগুলোর সুফল এখনও পুরোপুরি বাজারে প্রতিফলিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
গত অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি কত ছিল?
২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে অন্যতম উচ্চতম। এই হারের প্রভাব পড়েছে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের উপর, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোর উপর চাপ সবচেয়ে বেশি।
এক বছর আগের চিত্র
২০২৪ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, যা ছিল ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তখন দেশে খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি ও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছিল। যদিও পরবর্তীতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার ফলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিশ্লেষকদের মত
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে নয়। এর পিছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি তেলের দামের অস্থিরতা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মাহবুবুল আলম বলেন:
“মূল্যস্ফীতির বর্তমান ধারা দীর্ঘস্থায়ী হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যদি কর্মসংস্থান না বাড়ে এবং মজুরি বৃদ্ধির হারে স্থবিরতা থাকে, তাহলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে তা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে।”
ভবিষ্যতের জন্য করণীয়
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নিতে হবে আরও কার্যকর পদক্ষেপ:
- উৎপাদন খাতকে উৎসাহ দেওয়া, বিশেষ করে কৃষিপণ্য ও শিল্পপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো
- বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, যাতে মজুতদার ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে থাকে
- জরুরি পণ্যের ভর্তুকি কার্যক্রম বাড়ানো
- স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং
- মজুরি বৃদ্ধির উপযোগী পরিবেশ তৈরি
সারসংক্ষেপ:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতি | ৮.৫৫% |
জুন মাসের মূল্যস্ফীতি | ৮.৪৮% |
খাদ্য মূল্যস্ফীতি | ৭.৫৬% |
অ-খাদ্য মূল্যস্ফীতি | ৯.৩৮% |
২০২৪-২৫ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি | ১০.০৩% |
এক বছর আগে (জুলাই ২০২৪) খাদ্য মূল্যস্ফীতি | ১৪.১০% |
MAH – 12186 , Signalbd.com