ভেনেজুয়েলায় বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা বর্তমানে এক ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে। দেশটির সরকার এখন বেসামরিক নাগরিকদের হাতে কলমে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নির্দেশে শুরু হওয়া এই প্রশিক্ষণে সাধারণ মানুষ সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ট্যাংক চালনা, অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধকৌশল শিখছেন। এর মাধ্যমে তারা জাতীয় প্রতিরক্ষায় সরাসরি অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
‘অপারেশন ইন্ডিপেনডেন্স টু হান্ড্রেড’: প্রশিক্ষণের বিশেষ নাম
এই সামরিক উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ইন্ডিপেনডেন্স টু হান্ড্রেড’। এর আওতায় দেশজুড়ে ৩০০-এরও বেশি সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ চলছে। ভেনেজুয়েলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ সেনা ব্যারাকে হাজির হয়ে নাম লেখাচ্ছেন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে।
প্রশিক্ষণার্থীরা যুদ্ধতত্ত্ব, সংঘবদ্ধ অভিযানের কৌশল, অস্ত্র ব্যবহারের নিয়মসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ সামরিক জ্ঞান অর্জন করছেন। শুধু তাত্ত্বিক নয়, হাতে-কলমে অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তব যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন তারা।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন,
“আমি আগে কখনো সামরিক প্রশিক্ষণ নিইনি। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। আমাদের মতো নাগরিকদের জন্য এই প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। ভেনেজুয়েলার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদেরও ভূমিকা রাখা উচিত।”
মাদুরোর নির্দেশে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক
গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলিভারিয়ান মিলিশিয়ার সব সদস্যকে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরই রাজধানী কারাকাসের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফোর্ট টিউনাসহ শত শত ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
সরকারের আহ্বানে ব্যাপক সাড়া মেলে। হাজারো নাগরিক স্বেচ্ছায় সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দেন। মিলিশিয়ার মহড়া পরিদর্শন করতে যান দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ। তিনি ঘোষণা করেন,
“এখন থেকে নিয়মিত বড় আকারের সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। এর মাধ্যমে দেশের প্রতিরক্ষা ও শান্তি রক্ষায় আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকব।”
যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্কের টানাপোড়েন
ভেনেজুয়েলার এই উদ্যোগের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনা।
- যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় মাদক চোরাচালান দমনের অজুহাতে ক্যারিবীয় সাগরে সেনা মোতায়েন করেছে।
- ভেনেজুয়েলা সরকার এটিকে দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
- ২০১৯ সাল থেকেই ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র নিকোলাস মাদুরোকে অবৈধ প্রেসিডেন্ট আখ্যা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে সমর্থন জানায়।
- এরপর থেকে ভেনেজুয়েলার ওপর একাধিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণেই মাদুরো সরকার জনগণকে সরাসরি সামরিক প্রস্তুতিতে যুক্ত করছে। এটি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনেরও অংশ।
কেন সাধারণ নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে?
ভেনেজুয়েলায় মিলিশিয়া বাহিনী বহু বছর ধরেই সক্রিয়। তবে এবার সাধারণ জনগণকে এমন প্রশিক্ষণে যুক্ত করার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে:
- জাতীয় প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা – সম্ভাব্য বিদেশি হস্তক্ষেপ ঠেকাতে জনগণকে প্রস্তুত রাখা।
- জাতীয় ঐক্য জোরদার করা – নাগরিকদের সরাসরি অংশগ্রহণ সরকারের প্রতি আস্থা ও ঐক্য বাড়ায়।
- অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা – শুধু বাইরের হুমকি নয়, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দমনে প্রশিক্ষিত জনগণ ভূমিকা রাখতে পারে।
- রাজনৈতিক বার্তা – যুক্তরাষ্ট্র ও বিরোধী শক্তির প্রতি মাদুরোর শক্তিশালী অবস্থান প্রদর্শন।
লাতিন আমেরিকার সামরিক প্রেক্ষাপট
বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলার এই পদক্ষেপ নতুন নয়। লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে এমন নজির একাধিকবার পাওয়া গেছে।
- কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর আমলে সাধারণ মানুষকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
- নিকারাগুয়ায় স্যান্ডিনিস্তা সরকারও নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়ানোর জন্য।
- ভেনেজুয়েলা এবার সেই ধারা অনুসরণ করছে নতুন আঙ্গিকে।
এতে করে ভেনেজুয়েলা শুধু নিজ দেশের প্রতিরক্ষা বাড়াচ্ছে না, বরং পুরো অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শনের বার্তাও দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ভেনেজুয়েলার এই সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে বলছে, এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
- রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা বলছে, সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিরক্ষা জোরদার করা ভেনেজুয়েলার অধিকার।
- জাতিসংঘ এখনও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি, তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে?
ভেনেজুয়েলার এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে কয়েকটি দিক নির্দেশ করতে পারে:
- অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি – জনগণ প্রশিক্ষিত হলে সরকারের ওপর আস্থা বাড়বে।
- আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি – যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা এটিকে হুমকি মনে করে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে।
- রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন – মাদুরো সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজের ক্ষমতার ভিত্তি দৃঢ় করবে।
- অর্থনৈতিক চাপ বাড়া – সামরিক কার্যক্রম চালাতে বাড়তি ব্যয় হবে, যা ভেনেজুেলার দুর্বল অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
ভেনেজুয়েলা বর্তমানে এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নির্দেশে সাধারণ মানুষকে সামরিক প্রশিক্ষণে যুক্ত করা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধু দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াবে না, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভেনেজুয়েলাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসবে।
তবে এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে শান্তি নাকি উত্তেজনা বয়ে আনবে, তা সময়ই বলে দেবে।
MAH – 12818 Signalbd.com