গাজায় ভয়াবহ হামলা: রক্তপাত, বাস্তুচ্যুতি ও বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আবারও রক্তক্ষয়ী হামলা। আকাশজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর মানুষের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। ঘরবাড়ি হারিয়ে লাখো মানুষ দিশেহারা হয়ে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এ যেন এক অনন্ত দুর্যোগের অধ্যায়।
কিন্তু শুধু গাজার ভেতরেই নয়, দূরদেশের রাস্তাঘাটেও এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শান্তির আহ্বান। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়ার বড় শহরগুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে প্রতিদিন। বার্লিন, লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিসসহ অসংখ্য নগরীর রাস্তায় ভেসে আসছে একটাই স্লোগান—“যুদ্ধ নয়, চাই শান্তি, চাই কূটনীতি।”
গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বিমান ও আর্টিলারি হামলায় গাজার অসংখ্য এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ—কোনো স্থানই নিরাপদ নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ১৫ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে।
শিশুরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে, মা–বাবা চোখে জল নিয়ে, আর আহত বৃদ্ধ–বৃদ্ধারা লাঠি বা ক্রাচে ভর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? সীমান্ত বন্ধ, আশ্রয় শিবির ভরপুর, খাবার–পানি সংকট চরমে।
এক পা–হারা বৃদ্ধের ছবি বিশ্বমাধ্যমে তুমুল আলোড়ন তুলেছে—তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে বাস্তুচ্যুত জনতার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। অন্ধকার রাতে শত শত পরিবার একসঙ্গে ছুটছে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের খোঁজে, অথচ সেই আশ্রয় যেন মিরাজের মতো দূরে সরে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ
জাতিসংঘ, রেড ক্রস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল—সবাই একসঙ্গে বলছে, গাজায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
- খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মারাত্মক।
- হাসপাতালে ওষুধ শেষ, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।
- আহতদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই।
- হাজার হাজার শিশু অপুষ্টি ও মানসিক আঘাতে ভুগছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এখনই যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তবে পুরো গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবরস্থানে পরিণত হবে।”
বার্লিনসহ বিশ্বজুড়ে শান্তি সমাবেশ
গাজার রক্তাক্ত দৃশ্য বিশ্ববাসীকে নীরব থাকতে দেয়নি। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে হাজারো মানুষ মিছিল করেছে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে। তাদের হাতে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা—
- “গাজায় গণহত্যা বন্ধ করুন।”
- “অস্ত্র নয়, চাই শান্তি।”
- “কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান।”
শুধু তাই নয়, ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড় চলাকালে ফিলিস্তিনপন্থী কর্মীরা বিশাল ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে রাস্তায় প্রদর্শন করেছে, যা গোটা বিশ্বমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, টরন্টো, ইস্তাম্বুল—সবখানেই শান্তির দাবিতে সমাবেশ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বলছে, “এ যুদ্ধ বন্ধ হোক। মানুষ বাঁচুক। শিশুরা স্বপ্ন দেখতে শিখুক।”
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
গাজার এই বিপর্যয় কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দীর্ঘ দশকের দুঃসহ সংঘাতই এর মূল।
- ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ভূমি হারাতে থাকে।
- কয়েক দফা যুদ্ধ, সীমান্ত বিরোধ, দখলদারিত্ব—সব মিলিয়ে সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়েছে।
- বর্তমানে গাজা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সীমান্ত, আকাশ, সমুদ্র—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
এই দীর্ঘ ইতিহাস আজকের মানবিক বিপর্যয়কে আরও গভীর করেছে।
কূটনীতির আহ্বান, যুদ্ধবিরতির দাবি
বিশ্ব নেতাদের অনেকেই এখন যুদ্ধবিরতির পক্ষে জোর দিচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও যুদ্ধবিরতির দাবি উঠছে। কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণ, কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং ভৌগোলিক স্বার্থ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।
ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা বলছেন, “যদি অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তবে গাজায় যে প্রজন্ম বড় হবে তারা শুধু ধ্বংসই দেখবে, শান্তির কোনো স্বপ্ন দেখতে পারবে না।”
গাজায় প্রতিদিন মৃত্যু, রক্তপাত আর বাস্তুচ্যুতির নতুন অধ্যায় যোগ হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যখন শান্তির স্লোগান দিচ্ছে, তখন গাজার শিশুরা এখনো গোলার শব্দে কেঁপে উঠছে। এই বৈপরীত্যই আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
একটাই প্রশ্ন জেগে ওঠে—কবে থামবে এই রক্তপাত? কবে শুরু হবে আলোচনার নতুন পথ?
MAH – 12811 Signalbd.com