বিশ্ব

রাশিয়ার সামরিক মহড়া, সীমান্তে ৪০ হাজার সেনা পাঠাচ্ছে পোল্যান্ড

রাশিয়ার মহড়া ঘিরে সীমান্তে উত্তেজনা

রাশিয়া ও বেলারুশ যৌথ সামরিক মহড়া “জাপাদ-২০২৫” শুরু করতেই পূর্ব ইউরোপে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এর জের ধরে পোল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছে, তারা সীমান্তে সেনা সংখ্যা চার গুণ বাড়িয়ে ৪০ হাজারে উন্নীত করবে।

এতদিন সীমান্তে প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন ছিল। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক মহড়াকে “আক্রমণাত্মক ও উসকানিমূলক” বলে মনে করছে পোল্যান্ড সরকার। তাই অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি তারা ন্যাটো মিত্রদেরও সতর্ক করছে সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতির জন্য।

রুশ ড্রোন নিয়ে নতুন সংকট

পোল্যান্ডের সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক রুশ ড্রোন অনুপ্রবেশ। গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর রাতে রাশিয়ার ১৯টি ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় প্রবেশ করে বলে অভিযোগ করেছে ওয়ারশ। এর মধ্যে কয়েকটি ড্রোনকে ভূপাতিত করা হয়েছে, যেগুলোকে সরাসরি হুমকিস্বরূপ মনে করা হচ্ছিল।

তবে রাশিয়া দাবি করেছে, ভূপাতিত হওয়া ড্রোন তাদের নয়। অন্যদিকে বেলারুশ বলছে, কয়েকটি ড্রোন হয়তো পথ হারিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং তারা আগেই পোল্যান্ডকে সতর্ক করেছিল।

কিন্তু পোল্যান্ড এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। দেশটির জাতীয় প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী সেজারি টমচিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন:
“আমাদের কাছে স্পষ্ট, এই ড্রোন অনুপ্রবেশ কাকতালীয় কিছু নয়। এটি সরাসরি রাশিয়া-বেলারুশ মহড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।”

NATO ও পোল্যান্ডের যৌথ মহড়া

রাশিয়া-বেলারুশ মহড়ার জবাবে পোল্যান্ডও নিজেদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শনে পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পোল্যান্ড ও ন্যাটোর যৌথ মহড়ায় ৩০ হাজারের বেশি সেনা অংশ নিয়েছে।

টমচিক বলেন,
“পোল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরেই জাপাদ মহড়ার মতো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের মহড়ায় ন্যাটোর সেনাদের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি শুধু পোল্যান্ড নয়, বরং পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার প্রশ্ন।”

ইউক্রেন যুদ্ধ ও সীমান্তের নিরাপত্তা

পোল্যান্ডের এই বাড়তি সতর্কতার আরেকটি কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন ইতোমধ্যে পোল্যান্ডকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। কিয়েভ মনে করছে, রাশিয়ার মহড়া ও ড্রোন অনুপ্রবেশ ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রাশিয়া-ন্যাটো সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের পর এই সম্পর্ক চরম উত্তেজনায় পৌঁছে যায়। সেই সময় থেকে পোল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে অন্যতম কড়া অবস্থান নিয়ে আসছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর নিন্দা

রাশিয়ার ড্রোন অনুপ্রবেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইইউয়ের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কাল্লাস বলেন:
“রাশিয়ার এই পদক্ষেপ শুধু পোল্যান্ড নয়, বরং ইউরোপীয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এটি একটি গুরুতর উসকানি, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি নষ্ট করতে পারে।”

কাল্লাস আরও বলেন, ইউরোপকে এখন আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ রাশিয়ার মহড়া কেবলমাত্র সীমান্ত সুরক্ষার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ারও একটি কৌশল।

রাশিয়া-বেলারুশের মহড়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

“জাপাদ” নামের এই সামরিক মহড়া সাধারণত প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েক হাজার সেনা, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন ব্যবহৃত হয়। রাশিয়া দাবি করে, এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক মহড়া।

কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, এই মহড়ার আসল উদ্দেশ্য হলো ন্যাটোর সীমান্তে ভয় দেখানো। বিশেষ করে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও লাতভিয়ার মতো দেশগুলোকে রাশিয়ার সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা।

পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা কৌশল

পোল্যান্ড গত কয়েক বছরে তাদের প্রতিরক্ষা খাতকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আধুনিক ট্যাংক, যুদ্ধবিমান এবং মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে।

২০২৪ সালের বাজেটে পোল্যান্ড তাদের জিডিপির প্রায় ৪% প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করেছে, যা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে দেশটি ন্যাটোর অন্যতম শক্তিশালী সদস্য হিসেবে উঠে আসছে।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোন দিকে?

বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া ও পোল্যান্ডের এই টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। রাশিয়া যদি সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত সামরিক মহড়া চালিয়ে যায় এবং ড্রোন বা মিসাইল অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকে, তবে ইউরোপে নতুন এক নিরাপত্তা সংকট তৈরি হবে।

ন্যাটো ইতোমধ্যেই বলেছে, তারা পোল্যান্ডকে রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সরাসরি সংঘাত শুরু হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

রাশিয়া ও বেলারুশের যৌথ সামরিক মহড়া “জাপাদ-২০২৫” কেবল একটি মহড়া নয়—এটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য বড় পরীক্ষা। পোল্যান্ডের সীমান্তে ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করা এ সংকটের গুরুত্বই প্রমাণ করে।

বর্তমানে ইউরোপের রাজনীতি ও সামরিক প্রস্তুতি পুরোপুরি রাশিয়া-ন্যাটো সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। এই পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা শুধু পূর্ব ইউরোপ নয়, বরং পুরো বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

MAH – 12766,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button