কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না, এ ভূমি আমাদের: নেতানিয়াহু

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আবারও ঘোষণা করেছেন, ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে গড়ে উঠবে না। পশ্চিম তীরে নতুন করে হাজার হাজার বসতি স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে তিনি প্রকাশ্যে জানান, এ ভূমি সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য এখানে স্বাধীন রাষ্ট্রের কোনো জায়গা নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীরের দখলীকৃত এলাকায় বসতি সম্প্রসারণ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কিত “দুই রাষ্ট্র সমাধান” (Two State Solution) কার্যত ধ্বংসের মুখে পড়ল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নেতানিয়াহু বলেন,
“আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছি। কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। এই ভূমি আমাদের। আমরা এখানে আমাদের জনগণকে স্থায়ীভাবে বসবাস করাবো।”
তিনি আরও জানান, নতুন প্রকল্পের আওতায় ৩,৪০০টি নতুন ইসরাইলি বসতি নির্মিত হবে, যার ফলে পশ্চিম তীর কার্যত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে এবং পূর্ব জেরুজালেম থেকে বড় অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের গুরুত্ব
পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনিদের কাছে ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু নতুন বসতি পরিকল্পনা কার্যকর হলে ফিলিস্তিনিদের রাজধানীর স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ইসরাইল দখল করে রেখেছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই দখলদারিত্ব অবৈধ হলেও ইসরাইল বারবার সেখানে বসতি স্থাপন করেছে।
বর্তমানে পশ্চিম তীরে ৬ লাখের বেশি ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী বাস করছে। এরা আধুনিক অবকাঠামো ও সামরিক সুরক্ষা পায়, অথচ স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিনই ভূমি হারাচ্ছে, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের শিকার হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে।
- জাতিসংঘ জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে নতুন বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত শান্তি প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে।
- আরব লীগ বলেছে, নেতানিয়াহুর বক্তব্য প্রমাণ করে ইসরাইল কখনোই শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়নি।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। প্রকাশ্যে শান্তির আহ্বান জানালেও তারা ইসরাইলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষ নেতানিয়াহুর ঘোষণায় ক্ষুব্ধ। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO) জানিয়েছে,
“নেতানিয়াহু ইসরাইলি দখলদারিত্বকে স্থায়ী করতে চাইছে। তিনি শান্তির সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছেন।”
গাজায় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, ফিলিস্তিনের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
পশ্চিম তীরের সাধারণ মানুষ মনে করছে, প্রতিদিন তাদের জীবন সংকুচিত হচ্ছে। বাড়ি ভাঙা, জমি দখল, চেকপোস্টে হয়রানি এবং অর্থনৈতিক অবরোধ তাদের জীবনকে অমানবিক করে তুলেছে।
বসতি প্রকল্পের ভয়াবহ প্রভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নতুন বসতি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে—
- ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে।
- পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনিদের হাতছাড়া হবে।
- পশ্চিম তীর দ্বিখণ্ডিত হয়ে ফিলিস্তিনিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
- শান্তি প্রক্রিয়া একেবারেই ভেঙে পড়বে।
দুই রাষ্ট্র সমাধান কি তাহলে শেষ?
গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক মহল “দুই রাষ্ট্র সমাধান”-এর পক্ষে ছিল। অর্থাৎ, ইসরাইলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কিন্তু নেতানিয়াহুর ঘোষণার পর এ সমাধান এখন প্রায় অবাস্তব হয়ে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল যদি বসতি স্থাপন থামায় না, তাহলে আগামী প্রজন্ম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নামও শুনতে পাবে না।
নেতানিয়াহুর ঘোষণায় আবারও স্পষ্ট হলো—ইসরাইল কখনোই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নতুন বসতি প্রকল্প শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের ভবিষ্যৎকেই ধ্বংস করছে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন এখন আরও দূরে সরে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে শান্তি শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
MAH – 12765, Signalbd.com