চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কোয়ারে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সামরিক কুচকাওয়াজে দেশটি আবারও বিশ্বের সামনে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করল। এই কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ৮০ বছর আগে জাপানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের বার্ষিকী উদযাপন, কিন্তু একই সঙ্গে চীন তার আধুনিক সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা তুলে ধরল।
চীনের সরকারিক সংবাদমাধ্যম এবং সামরিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছে, এই কুচকাওয়াজ কেবল একটি ঐতিহাসিক উদযাপন নয়, বরং সামরিক প্রযুক্তিতে চীনের আধুনিকতা ও ক্ষমতার প্রদর্শন। কুচকাওয়াজে নতুন অস্ত্র, ড্রোন প্রযুক্তি, লেজার ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছে।
নতুন আইসিবিএম: ডিএফ-৫ সি

এই কুচকাওয়াজে চীনের ডিএফ-৫ সি নামের তরল জ্বালানিচালিত অন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হলো। সামরিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার, যা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তকে আঘাত করতে সক্ষম। এছাড়া, এটি আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম এবং লক্ষ্যভেদে উচ্চতর নির্ভুলতা প্রদর্শন করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিএফ-৫ সি-এর প্রদর্শনী চীনের কৌশলগত সক্ষমতার দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করে যে চীন এখন বিশ্বের কয়েকটি দেশ যারা সম্পূর্ণ শক্তিশালী ICBM প্রযুক্তি সমৃদ্ধ।
মনুষ্যবিহীন প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ

চীনের সামরিক বাহিনী সম্প্রতি মনুষ্যবিহীন প্রযুক্তি ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়েছে। কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত মনুষ্যবিহীন স্থলযান বা ইউএভি-ভিত্তিক ল্যান্ড রোবট ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
এগুলি জটিল অভিযান যেমন উভচর নৌ-অবতরণ, নগরযুদ্ধ, মাইন অপসারণ এবং বোমা নিষ্ক্রিয়করণে অত্যন্ত কার্যকর। এগুলি দূর নিয়ন্ত্রণে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম এবং একাধিক অভিযানে নমনীয়ভাবে ব্যবহারযোগ্য। সামরিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এই ধরনের প্রযুক্তি মানব-যন্ত্র সমন্বিত যুদ্ধ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
ড্রোন বিধ্বংসী প্রযুক্তি

চীন এই কুচকাওয়াজে ড্রোন বিধ্বংসী অস্ত্রও প্রদর্শন করেছে। এতে রয়েছে:
- ডিরেক্টেড এনার্জি লেজার অস্ত্র
- মাইক্রোওয়েভ ভিত্তিক ড্রোন বিধ্বংসী সরঞ্জাম
- অ্যান্টি-ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র ও কামান ব্যবস্থা
বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে এক ধরনের ‘লৌহ ত্রিভুজ’ বা আয়রন ট্রায়াড হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই প্রযুক্তি কেবল ড্রোনকে নিষ্ক্রিয় করে না, বরং সম্পূর্ণ ধ্বংসও করতে সক্ষম।
চীনের এই নতুন অ্যান্টি-ড্রোন প্রযুক্তি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বাধুনিক এবং এটি ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধে নতুন কৌশলগত সম্ভাবনা তৈরি করবে।
সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
কুচকাওয়াজে চীন ছয় ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রদর্শন করেছে। এই ব্যবস্থা বহুমুখী এবং বহুস্তরীয়, যা চীনের সামরিক শক্তিকে আরও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী করেছে।

এছাড়া, চীনের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, প্রথমবারের মতো এই ধরনের সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রদর্শন করা হলো, যা প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রদর্শিত অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- এইচকিউ-১১, এইচকিউ-২০, এইচকিউ-২২ এ, এইচকিউ-৯ সি, এইচকিউ-১৯, এইচকিউ-২৯
- দীর্ঘ, মাঝারি ও স্বল্প পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা সমৃদ্ধ।
হাইপারসনিক জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

এই কুচকাওয়াজে চার ধরনের নতুন ওয়াই জে সিরিজের জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে তিনটি হাইপারসনিক।
- ওয়াইজে-১৫
- ওয়াইজে-১৭, ওয়াইজে-১৯, ওয়াইজে-২০
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন এবং বিমান থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য, যা চীনের সামুদ্রিক ও আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা শক্তিশালী করছে।
নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা ও মনুষ্যবিহীন আকাশযান

কুচকাওয়াজে নতুন ধরনের মনুষ্যবিহীন আকাশযান প্রদর্শিত হয়েছে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধের পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারে।
- এলওয়াই-১ লেজার অস্ত্র
- যুদ্ধজাহাজভিত্তিক চার প্রকার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
এগুলো একত্রিতভাবে ব্যবহারে দূর, মাঝারি ও স্বল্প পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
স্থল, সমুদ্র ও আকাশভিত্তিক কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র

চীন প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করেছে স্থল, সমুদ্র ও আকাশভিত্তিক কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবস্থা।
- জিংলেই-১: আকাশভিত্তিক দীর্ঘপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র
- জুলাং-৩: সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ICBM
- ডংফেং-৬১: ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ICBM
- ডংফেং-৩১: নতুন ধরনের স্থলভিত্তিক ICBM
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অস্ত্র ব্যবস্থা চীনের সামরিক কৌশলকে এমনভাবে শক্তিশালী করেছে, যা আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ কেবল ঐতিহাসিক উদযাপন নয়, বরং এটি বিশ্বকে চীনের সামরিক আধুনিকতা ও প্রযুক্তি শক্তি প্রদর্শনের একটি সুযোগ।
- নতুন ICBM, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বিধ্বংসী অস্ত্র
- মনুষ্যবিহীন স্থল ও আকাশযান
- সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
এগুলো প্রমাণ করে, চীন কৌশলগত ও প্রযুক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ড্রোন, লেজার ও হাইপারসনিক প্রযুক্তি বিশ্ব সামরিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
চীনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তি, কৌশল এবং মানববিহীন অস্ত্র ব্যবহারের দিক নির্দেশ করবে।
MAH – 12628, Signalbd.com



