ভূমিকম্পের মধ্যেই আফগান শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে পাকিস্তান

আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজারো মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও পাকিস্তান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া থামাচ্ছে না। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার আহ্বান উপেক্ষা করে সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে হাজার হাজার আফগান।
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা
গত ৩১ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুনার প্রদেশে ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর পরবর্তী কয়েকদিনে আরও একাধিক আফটারশক অনুভূত হয়, যেগুলোর মাত্রা ছিল ৪.৫ থেকে ৫.২। তালেবান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২,২০০ ছাড়িয়েছে এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৩,৬০০ জন। ধসে পড়েছে হাজারো ঘরবাড়ি, বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।
প্রতিনিয়ত নতুন লাশ উদ্ধারের খবর আসছে। উদ্ধারকাজ এখনো চলছে, আর আফটারশকের আতঙ্ক মানুষকে ঘিরে রেখেছে। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত
এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার অবৈধ আফগান অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া জোরদার করেছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় এই অভিযান আরও তীব্র হয়েছে। চমন ও তোরখাম সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী আফগানিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি পাকিস্তানকে অনুরোধ করেছিলেন এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া অন্তত কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করতে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তারা এক বিপর্যস্ত অঞ্চলে ফিরে যাচ্ছে। তবে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এ আহ্বানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
শরণার্থীদের দুর্দশা
ফেরত পাঠানো শরণার্থীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তারা প্রায় চার দশক ধরে পাকিস্তানে বসবাস করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা বা চাকরি সবকিছুই পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল। হঠাৎ করে সব ফেলে চলে যাওয়া তাদের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করছে।
একজন অভিবাসী মীর মিয়াখিল বলেছেন, “এত অল্প সময়ে সব ছেড়ে চলে যাওয়া অসম্ভব। আমরা এখানে পরিবার নিয়ে প্রজন্ম ধরে বসবাস করছি।”
অন্য এক শরণার্থী আতিকুল্লাহ মনসুর জানান, “আমরা বারবার আবেদন করেছি ধীরে ধীরে ও নিরাপদে ফেরত পাঠানোর জন্য, কিন্তু তা শোনা হয়নি। বরং প্রক্রিয়াটি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।”
এছাড়া অনেকে অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান ভিসা নবায়নের সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তারা ফেরত যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ ছাড়াও মানবাধিকার সংস্থাগুলো পাকিস্তানের এ অবস্থানের সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আফগানিস্তানে এখন হাজারো মানুষ নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্যের জন্য লড়াই করছে। এই সময়ে শরণার্থীদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো এক ধরনের মানবিক সংকট সৃষ্টি করবে।
জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, গত বছর থেকেই পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ১২ লাখেরও বেশি মানুষকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, এর মধ্যে চলতি বছরেই চার লাখের বেশি। সর্বশেষ অভিযানে প্রায় ১৩ লাখ আফগানকে টার্গেট করা হয়েছে।
পাকিস্তানের যুক্তি
পাকিস্তান সরকারের দাবি, সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গি হামলার সঙ্গে আফগান শরণার্থীদের একটি অংশ জড়িত। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের ফেরত পাঠানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। ইসলামাবাদ বলছে, বৈধ কাগজপত্রধারীদের ঝামেলা না হলেও যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে, তাদের দেশে ফিরতেই হবে।
তবে মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বৈধ ও অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে অনেক সময় স্পষ্ট বিভাজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে হাজারো পরিবার ভোগান্তিতে পড়ছে।
বিশ্লেষণ: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানের মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করবে। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকায় নতুন করে কয়েক লাখ মানুষের আগমন তালেবান সরকারের জন্য ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। একইসঙ্গে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কেও উত্তেজনা বাড়তে পারে।
একজন আঞ্চলিক বিশ্লেষক বলেছেন, “বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের উচিত ছিল মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি করা। কিন্তু তারা উল্টো বিপর্যয়ের সময় মানুষকে ফেরত পাঠাচ্ছে। এর ফলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা আরও গভীর হবে।”
পরিশেষে
ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে যখন আফগানিস্তান লড়াই করছে, তখন পাকিস্তানের কঠোর নীতি নতুন মানবিক সংকট তৈরি করেছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল এ সিদ্ধান্ত স্থগিতের আহ্বান জানালেও ইসলামাবাদ তা উপেক্ষা করছে। এখন প্রশ্ন হলো—এই প্রক্রিয়া কি আফগানিস্তানের বিপর্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে, নাকি ভবিষ্যতে কোনো সমাধান বের হবে?
এম আর এম – ১২০৭, Signalbd.com