বাবাকে নজরবন্দি, ভাইদের আটক—সৌদি রাজতন্ত্রে যেভাবে ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন

প্রারম্ভিকা: একটি শাসনের গল্প
সৌদি আরবের আধুনিক ইতিহাস মূলত পেট্রোলিয়ামের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে এই কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, যখন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (MBS) দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। দ্রুত, দৃঢ়চিত্তে এবং কখনো কখনো নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তিনি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে সৌদি রাজতন্ত্রের রূপান্তর শুরু হয়, যা শুধু রাজনীতিতেই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ক্ষমতা দখলের সূচনা: বাবা থেকে যুবরাজ পর্যন্ত
২০০৯ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান King Saud বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি রাজকীয় উপদেষ্টার ভূমিকায় কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে তার বাবা সালমান রাজা হওয়ার পর তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হন। মাত্র ৩১ বছর বয়সে, ২০১৭ সালের ২১ জুন, তিনি ক্রাউন প্রিন্স হন, যা সৌদি উত্তরাধিকার কাঠামোকে বাইপাস করে ঘটে। এই পদক্ষেপ তাকে রাজতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত করে।
সংসার ও প্রাসাদের পল্টন: বিদ্রোহীর পতন
২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে MBS একটি “দুর্নীতি বিরোধী” অভিযান পরিচালনা করেন, যেখানে প্রায় ৩৮০ জন প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও শীর্ষ কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। তাদের Ritz-Carlton হোটেলে আটক রাখা হয় এবং প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই অভিযান রাজনীতির কেন্দ্রীয় কাঠামোকে ভেঙে দেয় এবং MBS-এর ক্ষমতা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই পরিচালনার সুযোগ তৈরি করে।
ইয়েমেন সামরিক অভিযান: ক্ষমতার নতুন প্রান্ত
২০১৫ সালে MBS হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে সামরিক অভিযান শুরু করেন। এমনকি তার বাবা রাজার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে তিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার অভিযোগও ওঠে। এই যুদ্ধে লাখো মানুষ অসহায় হয়েছেন, বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিযান সৌদি আরবের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে নতুন মাত্রা দেয়।
সামাজিক সংস্কার ও Vision 2030-র সূচনা
MBS ঘোষণা করেন Vision 2030, যা সৌদি আরবের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার লক্ষ্যে গৃহীত একটি বৃহৎ পরিকল্পনা। এতে প্রযুক্তি, পর্যটন ও বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো যায়। নারীদের অধিকারেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়; ২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় এবং ২০১৯ সালে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও স্বাধীনতা বাড়ানো হয়। ধর্মীয় পুলিশ ও ওয়াহাবি প্রভাব কিছুটা হ্রাস পায়, যা রক্ষণশীল সমাজে কিছুটা উদারতার সূচনা করে। ঐতিহাসিক মসজিদ সংস্কারের প্রকল্পও Vision 2030-এর অংশ হিসেবে চালু হয়।
নতুন সৌদি’ বনাম মানবাধিকার লঙ্ঘন
২০১৮ সালে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়ে। CIA-সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা MBS-কে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দেখেছে। Amnesty International, Human Rights Watch ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা তার শাসনের সময় নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত নির্যাতন ও মতপ্রকাশের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছে। এই মানবাধিকার লঙ্ঘন সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
শক্তি কেন্দ্রিক উত্তরাধিকার: আগামী কে?
২০২৫ সালে Financial Times-এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, MBS এখনও তার উত্তরাধিকার নির্ধারণ করেননি এবং বর্তমানে কোনো ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স নেই। এই পরিস্থিতি ‘key-man risk’ তৈরি করেছে। সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে তার ভাই খালিদ এবং দূর সম্পর্কের কিছু প্রিন্স রয়েছেন, তবে আইনগত বাধা ও রাজনীতির জটিলতার কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো মBS-এর হাতে।
সারসংক্ষেপ
মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতায় ওঠার গল্প সাধারণ হলেও তার প্রভাব গভীর ও বহুমাত্রিক। তিনি আধুনিক সৌদি আরবের রাজকীয় আয়তনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, যেখানে উন্নয়ন ও উদারতার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ছায়াও স্পষ্ট। Vision 2030 সৌদি সমাজে পরিবর্তনের বীজ বোনেছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ তার বাস্তবতাকে প্রভাবিত করে। উত্তরাধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও, MBS-এর পদক্ষেপ রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা গ্রহণ সৌদি আরবের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আধিপত্য, সংস্কার ও বিতর্কের মিশেলে গড়ে উঠেছে ‘নতুন সৌদি’র ছবি। এই পরিবর্তন শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। InsightBD.com-এর পাঠকদের জন্য এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন সৌদি রাজতন্ত্রের বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা প্রদান করবে।
MAH – 12630