দীর্ঘ সাত বছর পর চীন সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন এই সফরকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলন। এই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ একাধিক দেশের শীর্ষ নেতারা যোগ দেবেন।
এসসিও সম্মেলন ও মোদির সফর
চীনের বন্দরনগরী তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিতব্য এবারের এসসিও সম্মেলনকে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বড় পরিসরের সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে যোগ দিচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ের বৈঠকে। শুধু তাই নয়, সম্মেলনের ফাঁকে মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সফরে বাণিজ্য, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সীমান্ত ইস্যু এবং সংযোগ বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো ভারতের অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে।
ভারত-চীন সম্পর্কের পটভূমি
২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাপকভাবে তলানিতে নেমে যায়। সীমান্তে উত্তেজনা, সেনা মোতায়েন ও সামরিক মহড়ার কারণে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মোদির এ সফরকে সেই আস্থাবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন
মোদি যখন চীন সফরে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রশাসন ভারতের ওপর নতুন করে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নয়াদিল্লির জন্য বড় ধাক্কা। অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চাপের এই প্রেক্ষাপটেই মোদির চীন সফর অনেকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় দিল্লি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনকে আরও গুরুত্ব দিচ্ছে।
রাশিয়া ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি
এবারের এসসিও সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও যোগ দিচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাশিয়া, চীন ও ভারতের সম্পর্ক আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য তৈরি করছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুপাক্ষিক জোটের মাধ্যমে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে।
এসসিওর গুরুত্ব
এসসিও প্রথমে ছয়টি ইউরেশীয় দেশের অংশগ্রহণে গঠিত হলেও বর্তমানে এটি ১০টি স্থায়ী সদস্য ও ১৬টি সংলাপ ও পর্যবেক্ষক দেশ নিয়ে একটি বৃহৎ আঞ্চলিক সংগঠন। নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও জোটটির প্রভাব বাড়ছে। ভারত এই সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, মোদির এ সফর শুধু ভারত-চীন সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন ধাপের সূচনা হতে পারে। মার্কিন নীতি পরিবর্তনের ফলে ভারত এখন আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক জোটে নতুন কৌশল খুঁজছে। অনেকে মনে করছেন, এই সফর ওয়াশিংটনের জন্য একটি বার্তা — দিল্লি এককভাবে কারও ওপর নির্ভরশীল নয়।
পরিশেষে
নরেন্দ্র মোদির সাত বছর পর চীন সফর নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি বড় খবর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা, সীমান্ত সংঘাতের স্মৃতি, রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং এসসিওর সম্প্রসারণ — সব মিলিয়ে এই সফর আগামী দিনগুলোতে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। তবে সফরের ফল কী হবে, তা নির্ভর করবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদি ও শি জিনপিং কী ধরনের সমঝোতায় পৌঁছান তার ওপর।
এম আর এম – ১০৭৯, Signalbd.com



