ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের ছায়া ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, এটি শুধু একটি মানবিক সংকট নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয়। অবরোধ, যুদ্ধ এবং অব্যাহত হামলার কারণে গাজা এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। খাদ্য সংকটে ভুগছে প্রায় সমগ্র জনসংখ্যা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা শিশুদের—যারা কেবল খাবারের জন্য কাঁদছে, কিন্তু খাবার পাচ্ছে না।
গাজায় মৃত্যুর মিছিল: অনাহারে ৩১৩ জনের মৃত্যু
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টি ও অনাহারে মারা গেছে আরও ১০ জন, যার মধ্যে রয়েছে দুই শিশু। চলমান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৩ জনে, এর মধ্যে ১১৯ জনই শিশু। এ সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেন এত ভয়াবহ অবস্থা?
ইসরায়েলের আরোপিত অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সামগ্রী এবং জ্বালানি প্রবেশ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে, বাজার ভেঙে গেছে, দোকানপাটে খাবারের নামগন্ধ নেই। ফলে মানুষ অনাহারে মরছে।
জাতিসংঘের সতর্কবার্তা: “দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছে”
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক উপপ্রধান জয়েস মুসুইয়া জানিয়েছেন, গাজার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে, বিশেষ করে গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিতভাবে দেখা দিয়েছে। যদি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক করিডর চালু না করা হয়, তবে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এই দুর্ভিক্ষ দক্ষিণাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন:
“বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ অনাহার, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষে এই সংখ্যা ৬ লাখ ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী অন্তত ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ হাজারেরও বেশি শিশু আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে। ক্লিনিকগুলো ভর্তি কঙ্কালসার শিশুর শরীর—তারা এতটাই দুর্বল যে কাঁদতেও পারছে না।
সেভ দ্য চিলড্রেন-এর প্রধান ইঙ্গার অ্যাশিং বলেছেন:
“গাজার শিশুদের পরিকল্পিতভাবে অনাহারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবেই ক্ষুধাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
দুর্ভিক্ষ: প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়
জাতিসংঘ স্পষ্ট করে জানিয়েছে, গাজার দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নয়। এটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। চলমান যুদ্ধ, অবরোধ, এবং সাহায্য প্রবেশে বাধার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে ভুগছে। এই অবস্থা “ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি” করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিন্দা, কিন্তু কোনো সমাধান নেই
বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৪টি সদস্য দেশ গাজায় দুর্ভিক্ষ অবসানের পক্ষে মত দিয়েছে। তারা অবিলম্বে, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে যুদ্ধবিরতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
এদিকে ইসরায়েল জাতিসংঘের দুর্ভিক্ষ রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, এই রিপোর্ট “ত্রুটিপূর্ণ এবং অপেশাদার”। তারা গাজার দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
গাজার মাটিতে কী ঘটছে? ভয়াবহ বাস্তবতা
গাজার হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের অবস্থা এমন যে চিকিৎসকরা পর্যন্ত কাঁদছেন। বেঁচে থাকার মতো শক্তি নেই শিশুদের শরীরে। অনেক শিশু এতটাই দুর্বল যে চোখ খুলতেও পারছে না। অনেকে ব্যথায় কাঁদতে পারছে না। কিছু শিশু মৃত্যুর আগে কাগজে লিখেছে—
“ইশ, আমি যদি আমার মায়ের কাছে স্বর্গে থাকতে পারতাম। সেখানে ভালোবাসা আছে, খাবার আছে, পানি আছে।”
আগে যেখানে শিশুরা আঁকতো শান্তির ছবি, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, এখন তারা আঁকছে শুধু খাবারের ছবি।
আগামী দিনে কী হতে পারে?
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে—যদি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথ না খোলা হয়, তবে গাজায় শিশু মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বাড়বে। মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যা আধুনিক ইতিহাসে বিরল।
সমাধানের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের করণীয়
✔ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা
✔ মানবিক করিডর চালু করে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করা
✔ আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো
✔ শিশুদের জন্য বিশেষ পুষ্টি কর্মসূচি
✔ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য শান্তি উদ্যোগ
গাজার এই দুর্ভিক্ষ শুধু একটি মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় নৈতিক চ্যালেঞ্জ। কোটি কোটি ডলারের অস্ত্রের বদলে যদি খাবার পাঠানো হতো, তবে হাজারো শিশুর জীবন রক্ষা পেত। আজও সময় আছে—বিশ্ব চাইলে এই মৃত্যুমিছিল থামানো সম্ভব।
MAH – 12519 , Signalbd.com



