
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। স্বামীকে বাঁচাতে লিভারের একটি অংশ দান করেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লিভার প্রতিস্থাপনের পর স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর তদন্তে নেমেছে এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালকে নোটিশ পাঠিয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, মৃত স্বামীর নাম বাপু কোমকার এবং স্ত্রীর নাম কামিনী কোমকার। বাপুর লিভারের জটিল অসুখ ধরা পড়লে চিকিৎসকরা তাঁকে লিভার প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। এরপর ১৫ আগস্ট পুনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়। স্বামীকে বাঁচাতে নিজের লিভারের একটি অংশ দান করেন স্ত্রী কামিনী।
তবে অপারেশনের পরপরই বাপুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও মাত্র দুই দিন পর ১৭ আগস্ট তিনি মারা যান। অন্যদিকে প্রথমে সুস্থ মনে হলেও ২১ আগস্ট কামিনীর শরীরে মারাত্মক সংক্রমণ ধরা পড়ে এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তাঁরও মৃত্যু হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় সব ধরণের নিয়মকানুন মানা হয়েছে। বাপু কোমকারের পূর্বে থেকেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা ছিল। পরিবারকে আগেই অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল।
তাঁদের দাবি, কামিনী শুরুতে ভালোই সাড়া দিচ্ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি সেপটিক শকে আক্রান্ত হন। শরীরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যাওয়ায় একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে। উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার পরও তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
স্বাস্থ্য দপ্তরের তদন্ত
এ ঘটনায় মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহ্যাদ্রি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নোটিশ পাঠিয়েছে। ডেপুটি ডিরেক্টর নাগনাথ ইয়েমপাল্লে জানিয়েছেন, সোমবারের মধ্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব তথ্য, রোগীর চিকিৎসার রেকর্ড ও অপারেশনের ভিডিও জমা দিতে হবে। তদন্তে সহযোগিতা না করলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।
পরিবারের অভিযোগ ও দাবি
কোমকার পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের দাবি, চিকিৎসকরা যথাযথভাবে বিষয়টি পরিচালনা করতে পারেননি। বিশেষ করে, স্ত্রী কামিনী সুস্থ হয়ে উঠলেও হঠাৎ করে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে হাসপাতালের অবহেলা থাকতে পারে বলে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। পরিবারটি এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে।
লিভার প্রতিস্থাপন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ
চিকিৎসকরা বলছেন, জীবিত দাতার লিভার প্রতিস্থাপন বিশ্বে সবচেয়ে জটিল শল্যচিকিৎসার একটি। এতে রোগীর পাশাপাশি দাতারও ঝুঁকি থাকে। কারণ, লিভার মানবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যার প্রতিটি অংশ জটিল কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ বা অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো জটিলতা প্রায়ই দেখা দেয়।
ভারতে প্রতিবছর কয়েক হাজার রোগী লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে দাতার সংকট, উচ্চ খরচ এবং ঝুঁকির কারণে অনেক সময় এ চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন হয় না। চিকিৎসকরা সব সময়ই রোগী ও পরিবারকে ঝুঁকির বিষয়টি জানিয়ে দেন।
পূর্বে এমন ঘটনা
ভারতে এর আগেও লিভার প্রতিস্থাপনের সময় জটিলতার কারণে রোগী বা দাতার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে দিল্লিতে এক একই ধরনের ঘটনায় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্ঘটনা প্রতিস্থাপন সার্জারির ঝুঁকির বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করছেন, এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হলো যে, লিভার প্রতিস্থাপন যতটা জীবন বাঁচানোর উপায়, ততটাই ঝুঁকিপূর্ণও। চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি রোগীর পরিবারকেও সব ধরনের ঝুঁকি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে অবগত থাকতে হবে।
বাপু ও কামিনী কোমকারের মৃত্যু মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি পুরো ভারতজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে আছে স্ত্রীর আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে আছে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ঝুঁকি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। তদন্ত শেষে সত্য কী বেরিয়ে আসে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে এ ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দিল — চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি যত দূরেই যাক না কেন, প্রতিটি শল্যচিকিৎসার মধ্যেই রয়ে গেছে এক অস্বীকারযোগ্য ঝুঁকি।
এম আর এম – ১০৩৭, Signalbd.com