চোখের জলে চিরবিদায় পাইলট তৌকিরের

রাজধানীতে বিমান দুর্ঘটনায় শহীদ হওয়া ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামকে নিজ শহর রাজশাহীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। প্রিয়জনের কান্না, সহকর্মীদের সালাম আর শত মানুষের চোখের জলে শেষ বিদায় জানানো হলো এই তরুণ বীরকে।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের দাফন সম্পন্ন, রাজশাহীতে শোকাবহ পরিবেশ
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ ফাইটার জেট বিধ্বস্ত হলে শহীদ হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেলে তার মরদেহ হেলিকপ্টারে করে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। সেখান থেকে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মরদেহ পাঠানো হয় তার উপশহরের বাসার সামনে। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবরা।
রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামে বিকেল ৪টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় হাজারো মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে রাজশাহী নগরীর সপুরা শাহী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজা শেষে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার।
দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপট: আকাশ থেকে সরাসরি ট্র্যাজেডি
গত ২১ জুলাই সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ ফাইটার বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনায় পাইলট তৌকির ইসলাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
দুর্ঘটনার মুহূর্তে পাইলট নিরাপদ অবতরণ চেষ্টার পাশাপাশি বিমানটিকে জনবহুল এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলে বিমানবাহিনী সূত্রে জানা গেছে। এতে প্রাণ বাঁচলেও নিজে জীবন উৎসর্গ করেন। তার এ ত্যাগকে অনেকে বলছেন ‘নীরব বীরত্ব’।
পরিবারের আহাজারি আর স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত পরিবেশ
রাজশাহী উপশহরের বাসায় পৌঁছানোর পর পাইলট তৌকিরের মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা, বাবা ও বোন। পিতার হাত ধরে কেবল একটি বাক্য উচ্চারণ করছিলেন তার ছোট বোন, “ভাইয়া কোথায় চলে গেলে?” — আশপাশের মানুষের চোখে পানি এনে দেয় এ দৃশ্য।
তৌকিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহিন বলেন, “ও সবসময় বলত, দেশের জন্য কিছু করতে চাই। ওর স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। সেই আকাশেই সে চিরতরে বিলীন হয়ে গেল।”
রাষ্ট্রীয় সম্মান ও সামরিক প্রটোকলের মধ্য দিয়ে জানাজা ও দাফন
জানাজা পূর্বে মরদেহ বহনকারী সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্স রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামে এসে পৌঁছায়। সেখানে সামরিক প্রটোকলে জাতীয় পতাকা মুড়ানো কফিনে রাখা হয় শহীদের মরদেহ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর অনুষ্ঠিত হয় জানাজা।
জানাজায় অংশ নেন রাজশাহীর সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। জানাজার পর মরদেহ সপুরা শাহী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।
ঢাকায়ও হয়েছিল প্রথম জানাজা ও ফিউনারেল প্যারেড
পাইলট তৌকিরের মরদেহ প্রথমে রাখা হয়েছিল কুর্মিটোলা ঘাঁটিতে। সেখানে প্রথম জানাজা ও বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই আনুষ্ঠানিকতা শেষে হেলিকপ্টারে করে মরদেহ রাজশাহী আনা হয়, যাতে নিজ শহরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা যায় এই শহীদের।
তরুণ পাইলট তৌকিরের জীবন ও ক্যারিয়ার
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। রাজশাহী থেকেই তিনি স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।
সহকর্মীদের মতে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দায়িত্বশীল এবং নেতৃত্বদানের গুণসম্পন্ন একজন অফিসার। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল বিমান চালানো, দেশের সেবা করা। সেই স্বপ্নপূরণের পথেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি।
জনগণের প্রতিক্রিয়া: একজন নীরব নায়ককে হারালাম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাইলট তৌকিরের প্রতি শোক প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনেরা। অনেকে বলছেন, “দেশ একজন সোনার ছেলে হারাল।” কেউ বলছেন, “ওর মতো সাহসী ছেলেরা আকাশে হারিয়ে যায়, কিন্তু মনে থেকে যায় চিরকাল।”
তার স্কুলের শিক্ষক বলেন, “তৌকির ছিল নির্ভরতার নাম। স্কুলে যেমন মেধাবী ছিল, তেমনি বিনয়ী ও পরোপকারী ছিল।”
বীরের মতো এলেন, বীরের মতোই বিদায় নিলেন
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের বিদায় শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য বেদনার। তার আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই মাটির প্রতিটি চূর্ণবিচূর্ণ অংশ রক্ষায় কেউ কেউ জীবনও দিয়ে দেন নিঃস্বার্থভাবে।
তৌকিরের মতো তরুণদের স্বপ্ন আর সাহসিকতা থেকেই জন্ম নেয় দেশের বীরত্বগাঁথা। প্রশ্ন থেকে যায়—এই আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্য দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত?