বিশ্ব

ভারতে এক মুসলিম বৃদ্ধকে মারধর করে জয় শ্রী রাম বলতে বাধ্য করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা

Advertisement

ভারতে মুসলিম বৃদ্ধকে জোরপূর্বক ‘জয় শ্রী রাম’ বলার জন্য মারধর

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পৌরী গড়ওয়াল জেলায় একটি শোচনীয় ঘটনা ঘটে, যেখানে একজন মুসলিম বৃদ্ধকে নির্মমভাবে মারধর করে জয় শ্রী রাম বলতে বাধ্য করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিজওয়ান নামে এই বৃদ্ধ ব্যক্তি স্থানীয় সমাজে শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত। তবে কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তি তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে এবং দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।

ঘটনাটি ঘটেছে রিজওয়ানের নিজ বাসভবনের কাছে, যেখানে তিনি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম করছিলেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মুকেশ ভাট, মনীশ বিষ্ট ও নবীন ভাণ্ডারি নামের তিন ব্যক্তি রিজওয়ানকে চড়, থাপ্পড় এবং verbal abuse করছেন। তারা জোরপূর্বক তাকে ‘জয় শ্রী রাম’ ও ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলতে বাধ্য করে। হামলাকারীদের মধ্যে একজন বলতে শোনা যায়, “এখানে হিন্দুদের শাসন চলে, বল জয় শ্রী রাম।”

ভিডিওতে ভয়াবহ হুমকি

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, হামলাকারীরা রিজওয়ানকে হুমকি দেয়, “তোমরা হালাল করে কাটো, আমরা তোমাদের ঝটকা করে কাটব।” অর্থাৎ, পশু কেটে যে পদ্ধতিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা পালন করে, একইভাবে তারা রিজওয়ানদের আঘাত করবে। একপর্যায়ে তারা ব্লেড আনার কথা উল্লেখ করে দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয়।

এই নির্মম দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে উত্তরাখণ্ডে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।

পুলিশি পদক্ষেপ ও তদন্ত

পৌরী গড়ওয়ালের সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ লোকেশ্বর সিং সাংবাদিকদের জানান, হামলাকারীরা ও রিজওয়ান সবাই স্থানীয় বাসিন্দা এবং ভারতীয় রেলের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে “অপরাধমূলক ভয়ভীতি প্রদর্শন” মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে স্থানীয় কমিউনিটি নেতারা পুলিশি পদক্ষেপকে যথেষ্ট মনে করছেন না এবং আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।

উত্তরাখণ্ডে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপট

উত্তরাখণ্ডে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে নির্বাচনী মরশুম, ধর্মীয় উৎসব বা সামাজিক উত্তেজনার সময় এই ধরনের হিংসার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ২০২১ ও ২০২২ সালে একই রাজ্যে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ এবং হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক হিংসা শুধুমাত্র শারীরিক আঘাত নয়, মানসিক নিরাপত্তার উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রায়ই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তারা প্রশাসনিক সহায়তার জন্য দ্বিগুণ চেষ্টা করতে বাধ্য হয়।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন অংশে নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীরা তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম সংগঠনগুলো পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে, তবে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করার জন্য স্থায়ী সমাধান দাবি করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন। অনেকে লিখেছেন, “ধর্মের নামে সহিংসতা বন্ধ হওয়া উচিত” এবং “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।”

বিশ্লেষক দৃষ্টিকোণ

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আঘাত নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। তারা আরও বলেন, এ ধরনের ঘটনা সামাজিক ভীতি ও বিভাজন সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

উত্তরাখণ্ডের পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেন, সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে তারা সামাজিকভাবে নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার নজরে এসেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সমতার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হুমকি এবং শারীরিক আক্রমণের ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

পুনরায় ঘটনার প্রভাব

উত্তরাখণ্ডের পৌরী গড়ওয়াল এলাকার স্থানীয় মানুষরা এখনও আতঙ্কে রয়েছেন। বিশেষ করে প্রবীণ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজ নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। স্কুল, মসজিদ ও বাজার এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

পুলিশি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত এখনও চলমান এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া স্থানীয় কমিউনিটি নেতারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মিলে সংখ্যালঘুদের মানসিক ও সামাজিক সমর্থন নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।

উত্তরাখণ্ডের এই ঘটনা ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়াবহ রূপ প্রদর্শন করেছে। একটি শান্তিপ্রিয় বৃদ্ধকে জোরপূর্বক ‘জয় শ্রী রাম’ বলার জন্য মারধর এবং দাড়ি কেটে দেওয়ার হুমকি দেওয়া দেশের নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।

পুলিশি পদক্ষেপ দ্রুত হলেও, সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব নয়।

ভিডিওটি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং দেশের মানুষ একত্রিত হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।

MAH – 12388 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button