বেসরকারি খাত মন্দা, ঋণ সংকট, সমাধান বিশ্লেষণ

ঢাকা, ২৯ জুলাই ২০২৫ – দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত বর্তমানে এক ভয়াবহ মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগের অভাব, ব্যাংক ঋণের সংকট ও ঋণ খেলাপিদের বাড়াবাড়ির কারণে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং অর্থনীতির গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের ঋণে শূন্যগামী প্রবৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনের শেষে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ঋণের প্রবৃদ্ধির এই কমবেশি হ্রাস দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ এখন সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে গত এক বছরে প্রায় এক চতুর্থাংশ ব্যাংক ঋণ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে।
ঋণ সংকটের কারণে নতুন প্রকল্প গ্রহণের উদ্যম ক্রমশ কমছে। যেসব কারখানা চলছিলো, সেগুলোর একাংশ এখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শ্রমিক ও শ্রমিক-শ্রেণীর ওপর, যাদের কর্মসংস্থান হারানোর সংখ্যা লক্ষাধিক।
ব্যাংক ও শিল্পের সংকট: মন্দার কারণ ও বিশ্লেষণ
গত আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সীমিত কার্যক্রম চালাতে বাধ্য হয়েছেন। ১৪টি ব্যাংকের মধ্যে বেশ কয়েকটির ঋণ কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ রয়েছে। কমপক্ষে পাঁচটি ব্যাংক গ্রাহকের জমাকৃত টাকা উত্তোলনে সমস্যায় পড়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু ব্যাংক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণাধীন। অন্যদিকে সালমান এফ রহমান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোরও ঋণ বিতরণ বন্ধ বা সীমিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলোতে ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে কমপক্ষে ২০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার কারণে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বেক্সিমকোর ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে, এস আলম গ্রুপ, ইনফিনিয়া গ্রুপ ও ইউনিটেক্স গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠানও বন্ধের পথে। এস আলম গোষ্ঠীর ঋণ ১.৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
চট্টগ্রামে গত সাত মাসে ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, মূলত অর্থায়ন সংকটের কারণে। এসব কারখানার বেশির ভাগ পোশাক, সুতা ও জুতা উৎপাদন কেন্দ্র। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ খেলাপির কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ঋণখেলাপি সমস্যা ও ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, প্রায় ১২০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়মিত করতে আবেদন করেছে। এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ীর ঋণ বিশেষ উদ্যোগের আওতায় নিয়মিত হয়েছে, কিন্তু সংখ্যা খুব কম, মাত্র ১০০টির মতো। বাকির ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত ও বন্ধ। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করে রেখেছে, ফলে শিল্প ও অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অনিয়ম রোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য, তবে ব্যবসায়ীরা এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ঋণের সুদহারও বাড়ছে, যা নতুন বিনিয়োগকে আরো কঠিন করে তুলছে। আর্থিক খাতে সংস্কার চলছে, ফলে নতুন প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রদান প্রায় বন্ধ।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরী বলেছেন, বর্তমান মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বাস্তবে বেসরকারি খাতের ঋণ সংকট ও শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, “এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে উৎসাহী নয়। ঋণ খেলাপিদের নীতিসুবিধা দেওয়া এবং সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে।”
গত জুলাই মাসে ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.১৩ শতাংশ, এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে জুনে পৌঁছেছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ। এই প্রবণতা উদ্বেগজনক এবং অবিলম্বে সুদ নীতি, বিনিয়োগে উৎসাহ ও শিল্প পুনরুজ্জীবনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব
বেসরকারি খাত দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮০ শতাংশ যোগান দেয় এবং জিডিপির বড় অংশে অবদান রাখে। শিল্প, বাণিজ্য ও পরিষেবা খাতের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি। অতএব, এই খাতের মন্দা অর্থনীতির জন্য এক বিশাল ধাক্কা।
সমাধান ও সুপারিশ
১. ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি ও নীতিসুবিধা: সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উচিত কঠোর নিয়মাবলী পর্যালোচনা করে সাশ্রয়ী ঋণ সুবিধা তৈরি করা, বিশেষ করে ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ীদের জন্য পুনর্গঠন পরিকল্পনা চালু করা।
২. সুদের হার নিয়ন্ত্রণ: বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হার সহনীয় রাখতে হবে যাতে ব্যবসায়ীরা নতুন উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত হয়।
৩. ব্যাংকিং খাতে সংস্কার: অনিয়ম ও দুর্নীতি কমিয়ে ব্যাংকিং খাতকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে হবে। গ্রাহক সুবিধা ও ঋণ পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
৪. নতুন শিল্প ও প্রযুক্তি উদ্যোগ: প্রযুক্তি ও নবীন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিল্পের আধুনিকীকরণ ও বৈচিত্র্য আনতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। ঋণ সংকট ও শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের চাহিদা বিবেচনা করে সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তোরণের পথ দেখাতে হলে এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন যুক্তিসংগত নীতি, বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
MAH – 12007, Signalbd.com