গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত ৪৪ ফিলিস্তিনি

গাজা উপত্যকায় আবারও রক্ত ঝরেছে। ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনে বুধবার রাতে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৪৪ নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার বরাতে জানা গেছে, এই হামলা সংঘটিত হয়েছে গাজার শেখ রাদওয়ান অঞ্চলে, যেখানে পুরো একটি আবাসিক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এই প্রাণঘাতী হামলা এমন এক সময় সংঘটিত হলো, যখন পুরো বিশ্ব ফিলিস্তিনে চলমান মানবিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ, রেড ক্রিসেন্ট, মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ইসরায়েলের কিছু ভেতরের কণ্ঠও এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
শেখ রাদওয়ানে রাতভর হামলা: ধ্বংস আর লাশের পাহাড়
বুধবার (৬ আগস্ট) রাতে ইসরায়েলি ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া হয় একের পর এক মিসাইল। লক্ষ্য ছিল গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শেখ রাদওয়ান এলাকা। এই হামলায় নিহত হন অন্তত ২৬ জন স্থানীয় বাসিন্দা। আহতের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। তাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘুমন্ত মানুষের ঘরবাড়ির উপর যখন বোমা পড়ছিল, তখন শুধু বিস্ফোরণের শব্দ নয়, শোনা যাচ্ছিল সন্তান হারানো মায়েদের হাহাকার।
একজন জীবিত উদ্ধারকৃত ব্যক্তি বলেন,
“আমি চোখ খুলে দেখি, আমার পাশে আমার তিনটি সন্তান রক্তে ভাসছে। আমি কিছু করতে পারিনি।”
ত্রাণ কেন্দ্রেও হামলা: ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর আর্তনাদ
শুধু আবাসিক এলাকায় নয়, ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রেও, যা ছিল আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এখানে খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৮ জন ফিলিস্তিনি।
এই কেন্দ্রটি নিয়ন্ত্রণ করছিল ইসরায়েল-সমর্থিত একটি প্রশাসনিক সংস্থা, যেখানে খাদ্য, পানি এবং ওষুধ দেওয়া হতো যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের। এই নির্মম হামলায় ফিলিস্তিনি জাতি শুধু মানবিক সহানুভূতি নয়, তাদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষক মারিয়া হেনডারসন বলেন:
“ত্রাণকেন্দ্রে হামলা শুধু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন নয়, এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।”
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত: মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, সেবা কমছে
গাজার প্রধান হাসপাতালগুলোর মধ্যে শেখ হামাদ, আল-আকসা ও আল-শিফা এখন কার্যত ধ্বংসপ্রাপ্ত। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার আহত ফিলিস্তিনি চিকিৎসার জন্য ভীড় করেন, সেখানে আজ ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তাররা বিশ্রামহীন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৬০ জনেরও বেশি মানুষ। খাদ্যের সন্ধানে বের হলেই গুলি, আর হাসপাতালেও নেই নিরাপত্তা।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে আজ পর্যন্ত: কত প্রাণ ঝরেছে?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই দুঃস্বপ্নের যুদ্ধ ইতোমধ্যে গাজাকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। আল জাজিরা, আল-আরাবিয়া এবং বিবিসি জানিয়েছে, চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে মোট নিহতের সংখ্যা পেরিয়ে গেছে ৬১ হাজার। আহতের সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। নিখোঁজ হাজারেরও বেশি।
শিশুরা যুদ্ধের বলি: খেলাধুলার বয়সে কবরস্থানে ঠিকানা
এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় বলি হচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুরা। জাতিসংঘ শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ)-এর তথ্য মতে, ২০২৪ সালেই গাজায় নিহত হয়েছে ১১ হাজারের বেশি শিশু। এদের মধ্যে কেউ স্কুলে যাচ্ছিল, কেউ খেলছিল, কেউবা নিজের মা-বাবার সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল।
বিশ্ব মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ছোট মেয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। চোখে-মুখে ধূলি, কণ্ঠে শুধু একটি কথা:
“আম্মু কই?”
ইসলামি দুনিয়ার প্রতিক্রিয়া: নিন্দা, তবে কার্যকর কিছু নয়?
মুসলিম বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠলেও ইসরায়েলি হামলা থামছে না। ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন), তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া একাধিকবার জরুরি বৈঠক করেছে। কিন্তু সমন্বিত সামরিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়।
পশ্চিমাদের নীরবতা: মানবাধিকার শুধুই কাগজে-কলমে?
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মতো বড় বড় শক্তিধর দেশগুলো মানবাধিকার রক্ষার কথা বললেও গাজা নিয়ে কার্যত তারা নীরব। বরং অনেক সময়ই দেখা গেছে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন,
“যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব কাঁপছে, সেখানে ফিলিস্তিনের মৃত্যু যেন খবরের পাতার নিচে পড়ে গেছে।”
গাজার প্রতিরোধ: ধ্বংসের মধ্যেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় তারা
সবকিছুর পরেও ফিলিস্তিনি জনগণ দমে যায়নি। গাজার প্রতিটি অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট প্রতিরোধ কেন্দ্র। তরুণরা লাঠি-খঞ্জর হাতে পাহারা দিচ্ছে পাড়া-মহল্লা। তারা জানে, অস্ত্রের লড়াইয়ে তারা জিতবে না, কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান তাদের পরিচয়।
একজন বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি বলেন:
“আমরা হয়তো মরব, কিন্তু মাথা নত করব না। আমাদের ইতিহাস গৌরবময়, আমাদের আত্মত্যাগ ভবিষ্যতের শক্তি।”
গাজায় যা ঘটছে তা শুধু একটি অঞ্চলের সংকট নয়, এটি মানবতার পরীক্ষা
গাজায় প্রতিদিন যা ঘটছে, তা যেন ২১ শতকের সবচেয়ে বড় মানবিক লজ্জা। শিশুদের কান্না, মায়েদের আর্তনাদ, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর – এইসব কিছু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যুদ্ধ কখনো সমাধান হতে পারে না।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার সংস্থা, মুসলিম বিশ্ব এবং মানবিক মানুষদের এখনই সময় গাজার পাশে দাঁড়ানোর। কারণ নিরবতা এখানে অপরাধের সমান।
MAH – 12179 , Signalbd.com